সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এখনো যার উপর ভরসা রাখি

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সমাজতন্ত্রের প্রতি তার দুর্বলতা অপার, পক্ষপাত প্রশ্নহীন। পছন্দ করেন সমাজতন্ত্রী পরিচয়। স্বচ্ছন্দবোধ করেন কার্ল মার্ক্স, শ্রেণি সংগ্রাম, মানুষের মুক্তি, সামাজিক সাম্য ও মানবের কল্যাণে লিখতে-পড়তে ও পড়াতে। তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আজ তার ৮৭তম জন্মদিন। বয়সে বার্ধক্যের উপস্থিতি অনেক আগে ঘটলেও চেতনায়-বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে এখনও তিনি টগবগে এক যুবক। সোজা শিরদাঁড়ায়, ন্যায্যতার প্রসঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ্ব বাংলাদেশে তুলনারহিত এক নাম।

দেশের কোটি মানুষের মাঝে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেন খ্রিস্টপূর্ব কালের নগর রাষ্ট্র গ্রিসের দার্শনিক সক্রেটিস। জ্ঞান চর্চায় যার ব্যাপ্ত জীবনের লক্ষ্য-মহত্তম এক উদ্দেশ্য। লেখালেখির ভরকেন্দ্রে সমাজতন্ত্র ও তার অনুষঙ্গসমূহের উপস্থিতি প্রবল রেখেই তিনি দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেননি, যাপন করেছেন সমাজতন্ত্রের প্রতি উৎসর্গীকৃত এক জীবন। লেখালেখির বিষয়-বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়-যদিও সেসবের বেশিরভাগেরই অভিমুখ তার পছন্দের জায়গাকে ঘিরেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুলুকসন্ধান ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে তার আগ্রহ ঈর্ষণীয়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের পটভূমি-প্রেক্ষিত ও ইতিহাসের চাপানউতোর নিয়ে যে অবলোকন হাজির করেছেন এ সংক্রান্ত বই 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ', এবং 'জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষের মুক্তি'তে- তা শুধু তাৎপর্যবাহী নয়, কৌতূহলোদ্দীপকও। জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র—রাজনীতির প্রধান দুই প্রপঞ্চ। আধুনিক রাষ্ট্রের স্তম্ভসমূহের অন্যতম, যা কোথাও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত, কোথাও নয়। তবে রাজনীতিতে উপেক্ষিত নয় কোনোভাবেই-রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রয়েছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ, পক্ষে-বিপক্ষে জারি আছে ক্লান্তিহীন এক তর্কযুদ্ধ।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে মান্যতা দিয়েছে সর্বাধিক গুরুত্বে-যথাযোগ্য মর্যাদায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখালেখি ও পড়াশোনার প্রার্থনালয়ে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের যুগল উপস্থিতি কৌতূহলোদ্দীপক ও সবিশেষ বার্তাবাহী। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের এই দুই প্রধান প্রপঞ্চের অবলোকন ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে তার দৃষ্টিভঙ্গি-স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, দুর্বলতা ও পক্ষপাত কেমন ও কতোটা যৌক্তিক—সেই অনুসন্ধানের নিমিত্তে এই লেখা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতার পুরোটা সময় কেটেছে ঢাকায়—প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চশিক্ষা দেশের বাইরে, যুক্তরাজ্যে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষাশেষি আইয়ুব খান যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক হিসেবে হোন আবির্ভূত-তখন যোগ দেন শিক্ষকতায়। ইতিহাসের ধূসর পাতায় ঘটতে থাকে বিবিধ সব ঘটনা। পাকিস্তানের শোষণ-শাসন, বঞ্চনা-নিগ্রহের মতো সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের পুরোটারই সাক্ষী তিনি। শিক্ষকতার ঊষালগ্নেই লেখালেখিকে বেছে নেন মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন-অগ্রগমন-প্রগতিশীলতা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের আদর্শিক প্ল্যাটফর্মরূপে। শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ের প্রতি ছিলেন ভীষণভাবে অনুরক্ত। সম্পাদনা কাজের মধ্যে খুঁজে পান ভালোলাগার অপার্থিব এক আনন্দ।

প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয়তার গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন- স্বাধীনভাবেও আপন পৌরহিত্যে প্রকাশ করেছেন একাধিক সাময়িকী। ৮৭তেও সম্পাদনা করছেন ত্রৈমাসিক সাময়িকী 'নতুনদিগন্ত'। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষকতার পাট চুকে গেলেও, ইমেরিটাস অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে দাঁড়ি পড়েনি সেখানে-জারি থাকবে ইহজাগতিক অধ্যায় গতিশীল থাকা পর্যন্ত।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষকতা পেশা, লেখালেখি ও সম্পাদকীয়তা নেশা, ইংরেজিতে যাকে বলে প্যাশন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ যে জীবন-তার দায় ও দায়িত্ব পালনের জন্যই লেখালেখিকে বেছে নিয়েছেন-অপরের কল্যাণ সাধনের ব্রত হিসেবে। একারণে শুধু পদোন্নতি-ডিগ্রি ও অন্যের সন্তুষ্টি ও তারিফ প্রাপ্তির লক্ষ্যে লেখালেখি না করে স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছেন এবং লেখালেখির সেই কল্যাণমার্গের অভিমুখ জারি রয়েছে আজও। তিনি যেহেতু রাজনীতি সচেতন লেখক ছিলেন এবং লেখালেখিকে 'আর্ট ফর আর্ট সেক' জ্ঞান করেননি, তাই উজানেই তরী বেয়েছেন। এই তরী বায়তে গিয়ে উপলব্ধি করেছেন একটা স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম থাকা কতোটা জরুরি। যেখানে ব্রিটিশ বেনিয়ার প্রেতাত্মাদের উপস্থিতি নেই। মালিকের আলটপকা খবরদারি নেই। কূপমণ্ডূক সম্পাদক ও তার চেলাদের আস্ফালন নেই। বোধ ও বোঝাবুঝির এই সমীকরণই তাকে নিজের একটা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সংকল্পবদ্ধ করেছে-সীমাহীন সাহস যুগিয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সংকল্প ও সাহস-সর্বদা উদাহরণ জাগানিয়া। যদিও এই উদাহরণে স্নাত হওয়ার সংখ্যা কেবলই হচ্ছে হ্রস্ব, লুপ্তপ্রায়। মানুষের আচরণ-প্রতিটি কাজ এমন হতে হবে যাতে, সেদিকে লক্ষ্য করলে প্রতিটির মধ্যেই তাকে মানুষ হিসেবেই দেখতে পাওয়া যায়। অন্য সবার ক্ষেত্রে একথা কতোটা সুপ্রযুক্ত ও সবিশেষ সত্যবহ, তা নিয়ে দ্বিধা-সংশয় ও সন্দেহ থাকলেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ক্ষেত্রে এসব প্রত্যয় প্রশ্নাতীতভাবে প্রযোজ্য-যথোপযুক্ত। 'বুদ্ধিজীবী' শব্দের সার্থক ও অর্থবহ প্রয়োগ তার ক্ষেত্রেই বুঝি সর্বাধিক প্রযোজ্য-সর্বাংশে গ্রহণীয়।

জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবলোকন ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে আমাদের রয়েছে কিছু প্রশ্ন-বিস্তর বিস্ময়। জাতীয়তাবাদ নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত সময়ে কীভাবে ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটল এবং বঙ্গে সেই জাতীয়তাবাদ কীভাবে শেকড় গজালো এবং বিস্তার ঘটলো, সেসব যেমন বলেছেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গেও যে নিজস্ব একটা জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো সে প্রসঙ্গও হাজির করেছেন। বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদেও যে বিভক্তি দেখা দিলো এবং জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গটি নতুন মাত্রা পেল সেসব সম্পর্কে করেছেন আলোকপাত ও বিস্তর আলোচনা।

১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ এর চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল, জাতীয়তাবাদের হাত ধরাধরি করে সাম্প্রদায়িক সংকটও কীরূপে বাঙালি জাতিকে দ্বিধান্বিত ও বিভক্ত করলো সেদিকের তথ্য-উপাত্তও হাজির করেছেন যথাসম্ভব এবং দেশভাগের মুহূর্তে তার ব্যবহার কীরূপে হলো তার সমুদয় দিক নিয়ে বিস্তর উদাহরণ হাজিরসাপেক্ষে বিশ্লেষণ করেছেন-খুঁজে ফিরেছেন এসবের ভেতর-বাইরের তাৎপর্যসমূহ।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে তার যে স্ফীতাকৃতির বই সেখানেও তিনি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও ক্রম ধারাবাহিকতা নিয়ে কথা বলেছেন এবং জাতীয়তাবাদ কোন কোন অনুষঙ্গের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সেসব হাজির পূর্বক সেগুলো নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে তার অবলোকন মুগ্ধকর, যুক্তিগ্রাহ্যও বটে।

লেখালেখি ও সাক্ষাৎকারে তিনি জাতীয়তাবাদ নিয়ে যেসব প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন তাতে স্পষ্টত হয়, তিনি যতোটা জাতীয়তাবাদী, তার চেয়ে অধিক সমাজতন্ত্রী। এবং সমাজতন্ত্রী পরিচয়কেই তিনি শিরোধার্য জ্ঞান করেন। এখানেই আমাদের কতিপয় প্রশ্ন-কিছু জিজ্ঞাসা-কিঞ্চিৎ অনুযোগ। যার সবটাই পিতার কাছে পুত্রের কৌতূহল নিবৃত্তির অভিপ্রায়ে। শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীর জ্ঞান চক্ষু উন্মীলনের লক্ষ্যে। গুরুর কাছে শিষ্যের ঋদ্ধ হওয়ার বাসনা পূর্ণ করার প্রত্যাশায়। প্রশ্নগুলো হলো:

এক. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাতীয়তাবাদের মধ্যে যেরকম বা যেভাবে অপূর্ণতা-খামতি লক্ষ্য করেন সমাজতন্ত্রে কেন নয়। জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে তিনি যতোটা নির্মোহ ও নিরপেক্ষ হয়ে ওঠেন সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে কি অবস্থান একেবারে বিপ্রতীপ কোণে? যে কোনো জিনিসের বাইরে থেকে দেখা এবং ভেতর থেকে দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকে, কখনো কখনো সেটা সাদা-কালোর মতো ভিন্নতরও দেখাতে পারে। একারণেই কি তার জাতীয়তাবাদী অবস্থান এবং সমাজতন্ত্রী আদর্শ ভিন্ন মেরুর হয়ে উঠেছে।

দুই. যে কোনো মানুষের কাছে সর্বাগ্রে জাতীয়তাবাদ কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? জাতীয়তাবাদের সকল সীমাবদ্ধতাকে আমলে নিয়েও কি এ কথায় প্রযোজ্য নয়, যে জাতীয়তাবাদ ব্যতিরেকে কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের বিকাশ সম্ভব নয়। বিশেষ করে রাশিয়ার ইউক্রেনের ওপর চাপানো যুদ্ধের পর বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তবতা যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব এখন নতুন করে জাতীয়তাবাদ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এবং এসব ভাবনা যে মোটেই অমূলক নয় তাতো সময় যত গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে, যুদ্ধের একশদিন পেরোনোর পর যেটা হয়েছে আরও বেশি প্রকটতর। এই সময় 'খাদ্য জাতীয়তাবাদ' বলে একটা প্রসঙ্গ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বিভিন্নভাবে।

এ লক্ষ্যে বিশ্বের কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। খাদ্য রপ্তানি তারা সীমিত করে এনেছে এবং কোনো কোনো খাদ্যের রপ্তানি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তারা মনে করছে, আগে নিজেদের নাগরিকদের কথা ভাবতে হবে। এই জাতীয়তাবাদকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? বরং যেসব দেশ তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমদানি নির্ভরতাকেই ধ্যান জ্ঞান করেছে, তাদেরতো অনুশোচনা হওয়া উচিত। যুদ্ধ যদি বাস্তবিকই দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে 'খাদ্য জাতীয়তাবাদ' আরও গভীরভাবে বুঝিয়ে দেবে যেকোনো দেশের জন্য জাতীয়তাবাদ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।

তিন. জাতীয়তাবাদের আলোচনায় আপনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উদাহরণ হাজির করেন, বলেন এরা কেউই জাতীয়তাবাদী নয়। যদিও তারা জাতীয়তাবাদকেই ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেন। আওয়ামীয় লীগ পুরোনো জাতীয়তাবাদী আর বিএনপি নতুন এবং নিজেদের নামের সঙ্গেই জাতীয়তাবাদকে যুক্ত করেছেন- এসব আপনারই বয়ান। প্রশ্ন হলো কোনো রাজনৈতিক দলের নিরিখে জাতীয়তাবাদকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা সমীচীন কি? বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের ব্যর্থতা যদি বামপন্থার ব্যর্থতা না হয়। তাহলে, আওয়ামী লীগ, বিএনপির ব্যর্থতা কেন জাতীয়তাবাদের ব্যর্থতা হবে। এই ব্যর্থতা কি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়ার সংকটের ব্যর্থতা নয়?

চার. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে একের পর এক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয় ঘটলো-এর পেছনে তো জাতীয়তাবাদী চেতনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। যদিও এসব ঘটনার পর সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র নিয়ে যতো জ্ঞানভিত্তিক চর্চা হয়েছে-জাতীয়তাবাদ নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও নয়। এই না হওয়ার পেছনের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন? জাতীয়তাবাদী হলেই কেবল একজন মানুষের পক্ষে আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে ওঠা সম্ভব। একজন মানুষের যেমন অপরকে ভালবাসতে হলে আগে নিজেকে ভালবাসতে হয়। নিজেকে যে ভালবাসে না, অপরকেও সে ভালবাসতে পারে না, ভালবাসতে জানে না। জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রেও কি একথা সমধিক ও সর্বাংশে প্রযোজ্য নয়। জাতীয়তাবাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে আগে তারপর রাজনীতির অপর প্রপঞ্চসমূহ। একারণেই বোধ করি আমাদের সংবিধানে সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হয়েছে। কারণ রাঙালির রাষ্ট্র প্রাপ্তির গোড়াতেই তো জাতীয়তাবাদের অবস্থান। সেই চেতনায় বাঙালিকে আত্মোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে- দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ করার সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে।

পাঁচ. জাতীয়তাবাদের ব্যবহারগত ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয়তাবাদতো রাজনৈতিক প্রপঞ্চ হিসেবে, দেশপ্রেমের বীজমন্ত্র হিসেবে এবং ন্যায্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে অসম্ভব গুরুত্ববহ। যার অন্তর্গত শক্তিকে যদি বাস্তবিকই কাজে লাগানো যায় এবং সেটা সংস্কৃতির মূলস্রোতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে তাহলে সেই জাতিকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে-এ জাতির সেই চেতনা শক্তির সন্ধান পেয়েই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'দাবায়ে রাখতে পারবা না।' 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।' জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত শক্তির বড়ো প্রমাণ ৭১-র বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রতো ছিল জাতীয়তাবাদ থেকে উৎসারিত-গভীরভাবে অনুপ্রাণিত।

সুতরাং, জাতীয়তাবাদী হওয়া কি জরুরি নয়? সমাজতন্ত্রী হওয়াটাও নিশ্চয় জরুরি। কেননা, মার্কসের মতো করে সামাজিক সাম্য ও ন্যায় বিচারের কথা কেউ বলেননি। কিন্তু মার্কসের এই মহতী উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলেও কি জাতীয়তাবাদী হওয়া অপরিহার্য নয়? জাতীয়তাবাদের কিছু জটিল ও ভয়ঙ্কর দিক রয়েছে নিশ্চয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ কিছু মন্দাবস্থার সৃষ্টি করে-বিপথগামী করে তোলার ঝুঁকি ডেকে আনে। কিন্তু এসবইতো জাতীয়তাবাদকে ভুল পথে পরিচালিত করার খেসারত।

জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র কোথায় মেলে আর কোথায় মেলে না, এসবের ফায়সালা হওয়া উচিত। এটাতো সত্যি কার্ল মার্কস যেভাবে বলে গেছেন-ঠিক সেভাবে সমাজতন্ত্রের সার্বজনীন ভাষ্য এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। একারণে সমাজতন্ত্রের রাশিয়া ভাষ্য-চীন ভাষ্য এক নয়। পশ্চিমা মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকলেও প্রাচ্য মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই মোটেই। প্রাচ্য মার্কসবাদ সম্পর্কিত আদৌ কিছু আছে কি না সেটাও নিশ্চিত নয় মোটেই। অথচ পশ্চিম থাকলে, প্রাচ্য তো অবধারিতভাবেই এসে যায়। সমাজতন্ত্রকে আপন করে নেয়ার স্বার্থেই চুলচেরা বিশ্লেষণ হওয়া অপরিহার্য। সমাজতন্ত্র কোথায় আমার আর কোথায় আমার হওয়ার নয় সেখানে কি তার সংশোধন ও সংস্কার হওয়া প্রয়োজন সেসব নিয়ে যতোবেশি কথা হবে ততো বেশি উপকৃত হবে তরুণ সমাজ-নতুন প্রজন্ম।

এখনও এদেশে যেসব মানুষের ওপর আমরা ভরসা রাখি, আশাবাদী হই, শরণ নেওয়ার অভয় আশ্রম বলে মনে করি। তাদের অনেকেই পাঁচ ও ছয় এর দশকের প্রতিনিধি এবং এদের বেশীরভাগই বামপন্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিংবা আছেন আজও। এই বাস্তবতার পরও বামপন্থা এখানে এখন অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। এ কি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে, নাকি বাম বুদ্ধিজীবীদেরও দায় রয়েছে বিস্তর। আপনি যেহেতু এখনও আমাদের জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন, তাই আপনার কাছেই এসব প্রশ্নের ফায়সালার দাবি। সমাজতন্ত্রের বাংলাদেশ ভাষ্যটা কী এবং কেমন হতে পারে সেটাও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় মোটেই।

বহুধাবিভক্ত বাম রাজনীতির এদেশে বাম আদর্শও খুপরিবদ্ধ হয়েছে-এসব থেকেও বামপন্থাকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন নয় কী? আপনি শিক্ষক-লেখক-সম্পাদক, আপনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর না পেলে অন্ধকার আরও বেশি গ্রাস করার সংশয়পথ কেবলই প্রশস্ত হবে।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

kazal123rashid@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

2h ago