সমসাময়িক রাজনীতি ও প্রতিপক্ষ নির্মূলের মনস্তত্ত্ব
বীভৎস! এ যেন ১০ বছর আগের সেই লোমহর্ষক ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। কয়েকজন যুবক অন্য এক যুবককে ধাওয়া করে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করছে। আর অসহায় যুবকটি বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছটফট করতে করতে একসময় শীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
তবে পার্থক্য একটু আছে। ১০ বছর আগের ঘটনাটিতে খুনিরা কোন রাখঢাক না করেই বীরদর্পে তাদের কাজ করেছে। আর ১০ বছর পরের ঘটনাটিতে খুনিরা নিজেদের মুখ ঢাকার জন্য হেলমেট ব্যবহার করেছে।
আরও একটা বিষয় আছে। দ্বিতীয় ঘটনাটিতে ছেলেটি মারা যাওয়ার পরও খুনিরা তাকে উপর্যুপরি কুপিয়েছে। কতটুকু বীভৎস মানসিকতার হলে কোনো মানুষ এমন কাজ করতে পারে তা আমি ভাবতেও পারি না।
পাঠক হয়তো বুঝতে পারছেন ১০ বছর আগের ঘটনাটি বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ হত্যার, আর ১০ বছর পরেরটি অতি সাম্প্রতিক সময়ের রাজধানীর নিউমার্কেট কাণ্ডে নিহত কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হত্যার দৃশ্য।
বিশ্বজিৎ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সাধারণত কোনো হিন্দু ছেলে ইসলামি ছাত্র শিবিরের হয়ে কাজ করে না। তবুও তারা তাকে খুন করেছিল এই ভেবে যে, সে একজন শিবির কর্মী (যেন শিবির কর্মীকে খুন করা একটি সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব)। আর নাহিদকে খুন করেছে এই ভেবে যে, সে নিউমার্কেট কাণ্ডে ঢাকা কলেজ ছাত্রদের প্রতিপক্ষের মানুষ।
ভাবতেই কেমন লাগে, একটা নিরীহ যুবককে তারই বয়সের একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক পিটিয়ে মেরে ফেললো। তাও শুধু এই কারণে যে, তাদের বিবেচনায় সে ছিল প্রতিপক্ষ। পিটুনিতে মরে গিয়েও সে নিস্তার পায়নি। হত্যাকারীরা তার মৃতদেহটাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। আশেপাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখলো, কেউ ছবি তুললো, কেউ ভিডিও করলো। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলোনা অন্তত এটুকু বলতে যে, ওতো মরেই গেছে, ওকে আর মেরে কী হবে?
১০ বছর আগের ঘটনায় যে মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল, নিউমার্কেট কাণ্ডেও একই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে—এই দেশ আমার এবং আমাদের। আমি এবং আমরা যা বলবো, যা করবো তার বিরোধিতা কেউ করতে পারবে না!
তাই এখানে কোনো প্রতিপক্ষ থাকতে পারে না, থাকতে দেওয়া হবে না। এই যে সমাজকে প্রতিপক্ষ শূন্য করার বাসনা, এ এক গভীর অসুখ যাতে ভুগছে গোটা সমাজ, গ্রাম থেকে শহর, গোটা রাষ্ট্র।
গত ২ দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অসুখটি আমাদের সমাজকে ক্যান্সারের মতো গ্রাস করে চলেছে। সামান্য একটু বিরোধ হলেই বিরোধীকে মুছে দিতে হবে পৃথিবীর বুক থেকে। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, এমনকি স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসায় পর্যন্ত এই অবস্থা। কোথাও কোনো প্রতিপক্ষ থাকতে পারবে না। দেশকে প্রতিপক্ষ শূন্য করার এই যে প্রক্রিয়া, তা যে গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা অনেকেই বুঝতে পারছেন না।
বলা বাহুল্য, এই মনস্তত্ত্বকে লালন করছে সরকার নিজেই। কারণ দেশে এখন একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায়। কর্তৃত্ববাদীরা প্রতিপক্ষ সহ্য করতে পারে না। যেমন পারেনি হিটলার, পারেনি পাকি শাসকেরা মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে। এই যে ছেলেটা মারা গেলো, কুরিয়ার সার্ভিসের এক সাধারণ কর্মচারী নাহিদ, তার কী অপরাধ ছিল? সে তো কোনো পক্ষই ছিল না। তাও প্রতিপক্ষ মনস্তত্ত্ব থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়।
ছেলের মর্মান্তিক হত্যার পর যখন সাংবাদিকরা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো তিনি ঘটনার বিচার চান কি না, তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, তিনি বিচার চান না। কেন চান না? কারণ, তিনি জানেন বিচার চেয়ে কোনো লাভ নেই।
আরও জানেন, এই দেশে এখন বিচার পাওয়ার অধিকার যাদের টাকা আছে তাদের, আর নয়তো যাদের শক্তিশালী রাজনৈতিক মামা আছে তাদের। তাই তো তিনি বিচার চেয়ে নিজেকে ছোট করতে চান না। কিন্তু এই যে সব জেনেও পুত্রহত্যার বিচার না চাওয়া, এ যে কত বড় প্রতিবাদ তা কি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারছে? পারছে না। পারলে এমন করে কয়েকদিন পর পর মায়ের বুক খালি হতো না।
নিউমার্কেট ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যায়, একদল হেলমেটধারী ছেলে নাহিদকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। এই হেলমেট সংস্কৃতিও বাংলাদেশে সন্ত্রাসের এক অভিনব সংযোজন। কয়েক বছর আগে কিশোর আন্দোলনের সময়ও এই হেলমেট বাহিনীকে মারমুখী হয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে। আজকাল হেলমেট পরে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া একটা স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিরোধী দলের কর্মসূচীর সময় এই হেলমেট বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহাবস্থান দেখে যে কেউ ভাবতেই পারেন যে এরা একে অন্যের পরিপূরক।
হেলমেট বাহিনী হেঁটে যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশ দিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। হয়তো বলার সাহস নেই। বললেই চৌদ্দ শিকের ভিতরে যেতে হবে।
আরও কথা আছে। নিউমার্কেট কাণ্ডে ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে। কেন? মামলা হলো, কিন্তু খুনের মামলার চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে উস্কানির মামলা! আর এই সবকিছুই জনমনে এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাহলে কি ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক পক্ষকে তার প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই এমনটি করা হয়েছে?
আসলে গত ২ দশকে দেশের বিচার তথা আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানসমূহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই ভেঙে পড়েছে। অনেকেই বলে থাকেন, দেশে গত এক দশকে যুদ্ধাপরাধ মামলাসহ বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হয়েছে। ভাবখানা এমন, দু-একটা চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার হলেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়! কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কি আমরা এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে, কোনো ঘটনা যদি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারে তাহলেই তার বিচার হবে। যে ঘটনা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে ব্যর্থ তার বিচারের দরকার নেই।
এই মানসিকতা ও মনস্তত্ত্ব দেশের সার্বিক বিচারিক উন্নয়নের পথে এক বিশাল বাধা। সাধারণ মানুষ যদি বিচার না পায়, তাহলে একদিন যে সে অলৌকিক বিচারের কড়িকাঠেই তার কপাল ঠেকাবে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এই অলৌকিকতা নির্ভরশীলতা যে দেশে মৌলবাদের প্রসারে ভূমিকা রাখবে তাতে অবাক হওয়ারও তো কিছু নেই!
নিউমার্কেট ঘটনার জের ধরে 'পুলিশের বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার' অপরাধে বিরোধী দলের একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নাহিদ বা মুরসালিন হত্যার অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। পত্রিকান্তরে জানা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি ছাত্র সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী জড়িত।
মজার ব্যাপার হলো নাহিদ হত্যার ২ দিনের মাথায় সরকারি ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন নেতা নাহিদের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাকে একটা সেলাই মেশিন উপহার দিয়েছেন। একজন নিহত ব্যক্তির ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন হওয়ার আগেই তার স্ত্রীকে ডেকে তার হাতে সেলাই মেশিন তুলে দিয়ে ফটোসেশন করার চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!
ভুল বললাম, এ শুধু হাস্যকরই নয়, এ বিচার নিয়ে মশকরা। এই মশকরা যত দ্রুত সম্ভব বন্ধ করতে হবে। নয়তো, প্রতিপক্ষ নির্মূলের অসুস্থ মনস্তত্ত্ব থেকে বের হওয়ার কোন পথই থাকবে না। তাই, ক্যান্সার আরও বেশি ছড়ানোর আগেই অপারেশনটা করা হোক। বন্ধ করা হোক সমাজকে প্রতিপক্ষ শূন্য করার অসুস্থ প্রয়াস। এটাই এখন সময়ের দাবী।
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা
moshtaque@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments