লতা সমাদ্দারের টিপ ও আমাদের সাম্প্রদায়িক মন

ছবি: সংগৃহীত

কপালে টিপ, পরনে শাড়ি—বাঙালি নারীর শাশ্বত পরিচয়ের অংশ। এ অঞ্চলে শুধু হরিদাসী নয়, সিঁথিতে সিঁদুর ছিল সাকিনা বিবিরও। পায়ে ছিল আলতার রঙ। ফরায়েজি আন্দোলনের পূর্বে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি পুরুষ লুঙ্গি নয়, পরতেন ধুতি।

একটা দেশ বা জনপদে মানুষের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে শত শত বছরের মিথস্ক্রিয়ায়, সংস্কৃতির অভিন্ন ঐক্যতানে। সেখানে দিনে দিনে বিভেদের দেয়াল তুলেছে আমাদের সাম্প্রদায়িক মন। নেপথ্যে আছে ধর্মের রাজনীতি ও বেসাতি।

তারই শিকার হলেন তেজগাঁও কলেজের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক লতা সমাদ্দার। লতা সমাদ্দার অভিযোগ করেছেন, গত শনিবার সকালে কর্মস্থলের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় পুলিশের পোশাক পরা একজন তাকে 'টিপ পরছোস কেন' বলে কটূক্তি করেন।

শেরে বাংলা নগর থানায় দায়ের করা অভিযোগে তিনি আরও বলেন, কটূক্তির প্রতিবাদ জানালে তার গায়ের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন পুলিশের পোশাক পড়া ওই ব্যক্তি।

লতা সমাদ্দার এই ঘটনা মুখ বুজে সহ্য করেননি, সাহস করে প্রতিবাদ করেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে অনেকে টিপ পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ছবি আপলোড করছেন।

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদেও এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংসদ সদস্য সূবর্ণা মোস্তফা। কিন্তু এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

কপালে টিপ দেওয়ার ব্যক্তি স্বাধীনতাটুকু যিনি হরণ করতে চান—এমন কূপমণ্ডূক চিন্তার ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থায় কীভাবে বহাল তবিয়তে আছেন কে জানে। কিছুদিন আগে আমাদের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কটূক্তি করতে দেখেছি। আমরা কী দিন দিন এভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি? অথচ আমাদের কথা ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব, পরমত সহিষ্ণু হব। ইট আর কংক্রিটের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের সমষ্টিগত মন কী তবে অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে যাচ্ছে?

১৯৯৭-২০০১ মেয়াদকালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। আমরা তখন স্কুলশিক্ষার্থী। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি একদিন বিকেলে। শিক্ষাবিদ হাবিবুর রহমান কোনো এক অনুষ্ঠানে ধীর লয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। উৎকর্ণ ও কৌতূহলী মন ও বয়স আমাদের। তাই কাদের বা কিসের আয়োজন তা না জেনেই দাঁড়ালাম।

সেই কিশোর বয়সে শোনা তার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। তিনি বলছিলেন, 'ব্যক্তির ধর্ম থাকে। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম পরিচয় থাকে না। রাষ্ট্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের।'

দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে আজকাল মাননীয় উপাচার্যদের এসব কথা বলতে শুনি না। এসব জ্ঞানান্বেষী কথার বদলে তারা বরং তাদের মেয়াদকালে উন্নয়ন-হিস্যার ভাগ বুঝে নেওয়া, শালা-শালী থেকে ঘরের কাজের বুয়াকে পর্যন্ত নিয়োগ দানের অপতৎপরতায় বেশি ব্যস্ত থাকেন।

অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বিভক্ত বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের সকল নাগরিকের কাছে আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার ৪ মূলনীতির অন্যতম 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা'র বার্তাটুকু পৌঁছাতে পারিনি। বুঝাতে পারিনি রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিশ্বাস আলাদা। রাষ্ট্র সকলের। বিশ্বাস ব্যক্তিগত। এটা আমাদের শিক্ষার সামগ্রিক ব্যর্থতা।

অথচ এইটুকু বোঝার জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের পিএইচডি-সুপারভাইজার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কি হতে হয় না। 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি'—রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্ম পরিচয়ের মানুষের নয়, সকলের। এই মর্মবাণীতে আস্থা রেখেই ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানের আগল ভেঙে আমরা দেশটা স্বাধীন করেছি।

রাষ্ট্রের মতো দলেরও ধর্ম পরিচয় থাকে না, বিশেষ করে যে দল বা তাদের অঙ্গ সংগঠন সকল মানুষের। অবশ্য ধর্মভিত্তিক দলও আছে, কিন্তু তারা সকল মানুষের নয়। তারা সম্প্রদায় বিশেষের। আমাদের রাষ্ট্র সকল মানুষের হয়ে উঠুক।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও গবেষক

alo.du1971@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

2h ago