বারবার একই ভুল, হুঁশ ফিরবে কবে!

পোশাক কারখানা ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথ ব্যবহার করে হাজারো মানুষ নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

আবারও সেই একই ভুল! আবারও সেই হঠকারিতা। এতদিন ধরে বলা হচ্ছিল, দেশে যতদিন কঠোর লকডাউন আছে, ততদিন কোনো শিল্পকারখানা খোলা হবে না। শুধু ঈদের আগে নয়, এই তো দুদিন আগেও মন্ত্রীরা বলেছিলেন, 'লকডাউনে খুলছে না কিছু'। কিন্তু, রাতারাতি সেই সিদ্ধান্ত বদলে গেল।

ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হলো, রোববার সকাল ছয়টা থেকে পোশাকসহ সব রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা বিধিনিষেধের আওতামুক্ত। এরপর রোববারই কাজে যোগ দেওয়ার জন্যে মালিকরা নির্দেশ দিলো। কিন্তু, চলমান কঠোর লকডাউনে শ্রমিকেরা দূর-দূরান্ত থেকে কীভাবে কর্মস্থলে ফিরবেন, তার কোনো নির্দেশনা ছিল না কোথাও। না সরকারি প্রজ্ঞাপনে, না মালিকদের কথায়।

শুক্রবার রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গেই এই নির্দেশনার ফলাফল দেখা গেল। লাখো মানুষ ছুটছেন ঢাকার দিকে। কিন্তু, গণপরিবহন নেই। ফলে মহাসড়কে অটোরিকশা, মাহেন্দ্রসহ ব্যক্তিগত সব গাড়ি। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ রিকশায়-অটোতে, আবার কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ফিরছেন। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরছেন লাখো মানুষ। যে যেভাবে পারছে ছুটছে।

শিমুলিয়া, আরিচা, দৌলতদিয়া, কাজিরহাট— সব ফেরি ঘাটেই মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের ছবি ইতোমধ্যেই চলে এসেছে গণমাধ্যমে। ফেরিগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। স্বাস্থ্যবিধি তো পরের কথা, মানুষের ভিড়ে ফেরিগুলোতে কোনো যানবাহনও পার করা সম্ভব হয়নি।

লকডাউনে গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্ত ঠিক নাকি ভুল, সেই আলাপে যাচ্ছি না। এটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। জীবন আর জীবিকার এই দ্বন্দ্ব চলছেই। কখনোই শতভাগ লোক এ বিষয়ে একমত হতে পারবেন না। কাজেই গার্মেন্টস খোলা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু, সরকারের সব নীতি-নির্ধারকরা যেখানে একমত হয়ে ঘোষণা দিলেন, এই লকডাউনে পোশাক কারখানা খুলছে না, সেই সিদ্ধান্ত কীভাবে বদলে গেল? আর ৩০ জুলাই বিকেলে ঘোষণা দিয়ে ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্ত তো কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।

পোশাক কারখানার কর্মীরা বলছেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন ও কারখানা বন্ধের ঘোষণা আসায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাড়িতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করে কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বিপদে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে ফিরছেন। কয়েকজন যাত্রী পাল্টা প্রশ্ন করে গণমাধ্যমে বলেছেন, 'সরকার লকডাউন দেয়, আবার লকডাউনের মধ্যে অফিসও খুলে দেয়, কেন?'

অবশ্যই এটা হঠকারী সিদ্ধান্ত। চলুন একটু পেছনে ফিরি। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত ২২ জুলাই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, ৫ আগস্টের আগে পোশাক কারখানা কোনোভাবেই খুলবে না। এবার বরং যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠোর লকডাউন হবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, 'অফিস, আদালত, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ সব কিছু বন্ধ থাকবে। যেহেতু অফিস বা কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকবে, যেহেতু যারা বাড়িতে গেছেন তারা সময় নিয়ে গেছেন, ৫ আগস্টের পরেই যেন তারা আসেন।'

শুধু ঈদের আগে নয়, গত ২৭ জুলাই দুপুরেও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, পুলিশ প্রধান, বিজিবি প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ওই বৈঠক শেষে সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, যে লকডাউন চলছে, তা ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলতে থাকবে। যদিও আমাদের শিল্পপতিরা পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, আমরা সেই অনুরোধ বোধহয় গ্রহণ করতে পারছি না।

চলুন এবার শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কথা শুনি। এই তো শুক্রবার দুপুরেও তিনি পরিষ্কার করে বললেন, আগে মানুষের জীবন, তারপর জীবিকা। যতদিন লকডাউন আছে, ততদিন কোনো শিল্প কারখানা খোলা হবে না। গতকাল দুপুরে ঢাকার ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের সীতি এলাকায় স্থানীয় লোকজন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি একথা বলেন।

পোশাক কারখানার কর্মীরা কাদের বিশ্বাস করবে? এত কথার পরেও কী করে শুক্রবার বিকেলে পোশাক কারখানা খোলার ঘোষণা এলো? আমরা জেনেছি, বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ব্যবসায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে যত দ্রুত সম্ভব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান। তার একদিন পরই রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলো সরকার।

এখন প্রশ্ন হলো—খোলার ঘোষণার আগে একবার অন্তত ভাবা উচিত ছিল, কীভাবে লাখো শ্রমিক ঢাকা আসবেন এখন? একবারও কেন নীতি-নির্ধারকরা ভাবলেন না, রোজ দুই থেকে আড়াই শ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ১৩ থেকে ১৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। গণপরিবহন বন্ধ। কীভাবে আসবেন শ্রমিকরা? এই যে লাখো মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এলেন, এর দায় কার?

জানি না এসব প্রশ্নের উত্তর আসলে কে দেবে! এই যে পথে পথে ভোগান্তি, বাড়তি খরচ এর দায় কার? নীতি-নির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন—আপনারা যদি খুলবেনই, ঈদের আগে কেন বলেছিলেন ৫ আগস্টের আগে কিছু খুলবে না, এমনকি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাও না?

আর যদি খুলবেনই, শ্রমিকদের ফেরার জন্যে অন্তত ৫-৭টা দিন সময় দেবেন না? মানুষগুলো কি উড়ে উড়ে আসবে? সরকার কেন মালিকদের বলেনি আপনারা বাস বা গাড়িতে করে সব শ্রমিকদের নিয়ে আসেন। সরকার কেন কোনো ব্যবস্থা দিলো না? এই যে দুদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ আসা-যাওয়া, এর ফলে মহামারি যে আরও ছড়াবে, তার দায় কে নেবে? বারবারই কেন নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়ে এই তামাশা?

এই যে আগামীকাল থেকে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হলো, এখন তো কঠোর লকডাউন বহাল রাখা আরেক বোকামি। কারণ লাখো লোক ঢাকায় ফিরবেন। কী দিয়ে আটকাবেন তাদের? আবার রোববার যেহেতু পোশাক কারখানা খোলা, রোজ লাখো মানুষ পোশাক কারখানায় যাবে, আবার ফিরবে। আটকাবেন কোন যুক্তি দিয়ে? মূলত এই ঘোষণায় লকডাউনই কার্যত অচল হয়ে গেল।

অবশ্য শুধু এবারই নয়। প্রতিবারই একই ঘটনা ঘটছে। গত দেড় বছর ধরে আমরা এই ভুল আর সমন্বয়হীনতার মধ্যেই আছি। কখনো লকডাউন, কখনো সীমিত লকডাউন, কখনো কঠোর লকডাউন, আরও কঠোর লকডাউন নাম দিয়ে যা হয়, তার ফলাফল কী? এপ্রিল থেকে কম-বেশি লকডাউন তো চলছেই। কিন্তু, পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে? এ নিয়ে সরকারের কোনো বিশ্লেষণ আছে কি?

সবার মনে রাখতে হবে, একটা দেশ ঠিক করতে হলে জনগণের সচেতনতা যেমন জরুরি, তারচেয়েও বেশি জরুরি নীতি-নির্ধারকদের দায়িত্ববোধ। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। আর কবে সেটা বাংলাদেশে হবে? আর কত মানুষ মরলে হুঁশ ফিরবে আমাদের?

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

shariful06du@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments