বাউফল থেকে কুলাউড়া: ফতোয়ার শেষ কোথায়?

নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা। ছবি:সংগৃহীত

দেশের ২ বিপরীত প্রান্তের ২টি খবর। একটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বাউফল উপজেলার, অন্যটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুলাউড়া উপজেলার। কিন্তু খবর ২টির মৌলিক চরিত্র প্রায় একই।

প্রথমটিতে স্থানীয়  পৌর নির্বাচনে মুসলিম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রকাশ্যে হিন্দু প্রার্থীকে ভোট না দিতে এই মর্মে ফতোয়া জারি করেছে যে, 'হিন্দুদের ভোট দেওয়া হারাম। হিন্দুদের ভোট দিলে বেহেশত হারাম হয়ে যাবে এবং যারা হিন্দুদের ভোট দেবে তাদের নামাজ-রোজা হবে না।'

অন্যদিকে  কুলাউড়ায় একজন মেয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ায় মসজিদভিত্তিক স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানেরা ওই মেয়ের পরিবারকে একঘরে করার আদেশ দিয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, ভুক্তভোগী পরিবারের মেয়েটি নাকি উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা গিয়ে সনাতন ধর্মের এক ছেলেকে বিয়ে করেছে। এই অভিযোগ তুলে তার অশীতিপর বৃদ্ধ বাবাকে, যিনি নিজে হজ্ব করে এসেছেন, মসজিদ পঞ্চায়েতের সামনে ডেকে পাঠায়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে পঞ্চায়েতের সামনে হাজির না হতে পারলে তার অনুপস্থিতিতেই 'একঘরে' করার রায় প্রদান করে।

২টি ক্ষেত্রেই বিষয়গুলো স্থানীয় প্রশাসনের গোচরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে কুলাউড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা নাকি উভয় পক্ষকে ডেকেছেন বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য!

ঘটনা ২টি এমন সময়ই ঘটলো যখন পুরো জাতি মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে আমাদের ভাষার মাস, সংস্কৃতির মাস, বাঙালির অহংকারের মাস ফেব্রুয়ারি। অন্তরে যাই থাকুক না কেন, এ কথা সুবিদিত যে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা একটু বেশি বেশি বাঙালি আর অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠি। সেটা আর কোথাও হোক বা না হোক অন্তত বক্তৃতা, বিবৃতি আর ফেসবুকে সেটা করি। সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে এমন ২টি ঘটনা বিদগ্ধজনদের কষ্টের কারণ হবে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়।

প্রথমেই আসা যাক বাউফলের ঘটনায়। ভাঙাচোরা যেমনই হোক না কেনো আমাদের নির্বাচনী আইন এবং নির্বাচনী আচরণবিধিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির সর্বক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নির্বাচন এলে তা নতুন মাত্রা লাভ করে। স্বাধীনতার পর সেই সত্তুরের দশক থেকেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করলেও ২০১৪ সালের পর থেকে এই প্রবণতা বিপজ্জনক মোড় নিতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যতই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদীরাও ততই জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই তারা ক্ষমতাসীন দলের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল এবং সরকারগুলো যখনই বৈধতার সংকটে নিপতিত হয় তখনই গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে গিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।  ২০১৪ সালের এর যাত্রা শুরু এবং ২০১৮ সালে চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে। সরকারের নৈতিক বৈধতার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল ২০১৮ সালের মধ্যরাতের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাও নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে সরকারি দলের আভ্যন্তরীণ সংকট হতে থাকলো প্রকট থেকে প্রকটতর। যার প্রমাণ ২০২১ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকার ভরাডুবি। এই অবস্থায় সরকার তার কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নির্ভরতার ২টি জায়গা বেছে নিলো। তার মধ্যে একটি আমলাতন্ত্র, অপরটি মৌলবাদ। আজকের বাংলাদেশে যেকোনো উপজেলার দিকে তাকালে এই সত্যটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে।

এই করোনা মহামারির সময়ে সব ধরনের সভা-সমাবেশ যখন নিষিদ্ধ,  মৌলবাদী গোষ্ঠী তখনও তাদের মাহফিল-মজলিস ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সব মাহফিলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সরকারি দলের হোমড়া-চোমরারা, কখনো কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও। এইভাবেই প্রথাগত রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাত থেকে সরে চলে যাচ্ছে আমলাতন্ত্র আর মৌলবাদীদের হাতে। এই প্রেক্ষিতে বাউফলে যা ঘটেছে তাতে ক্ষুব্ধ হলেও অবাক হওয়ার কিছু দেখছি না।

তারপরও কথা থাকে। একটা পৌর নির্বাচনে ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দু প্রার্থীদের ভোট না দেওয়ার পক্ষে ফতোয়া দেওয়া হলো, আর  প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল নীরবে তা মেনে নিলো। এ কেমন কথা? এ রকম ফতোয়া দেওয়া কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার পর্যায়ে পড়ে না? সেই অতি পরাক্রমশালী ৫৭ ধারা কোথায় গেলো? গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি পান থেকে চুন খসলেই অনুভূতির দোহাই তুলে ৫৭ ধারায় মামলা দেওয়া হচ্ছে। এই তো বছর খানেকও হয়নি লঙ্গদুর সুজন দে'কে অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনুভূতির অনুভবে আঘাত দেওয়ার জন্য ঝুমন দাস, রুমা সরকারসহ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আরও কতজন যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বিনা বিচারে জেলের ঘানি টেনেছে বা এখনও টেনে চলেছে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ প্রকাশ্যে পরধর্মকে হেয় করে ফতোয়া দেওয়ার পরও প্রশাসন নীরব। তাহলে কেউ যদি মনে করে  এই জাতীয় ফতোয়াবাজীর পেছনে প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদদ রয়েছে, তাতে কী খুব ভুল হবে?

এবারে আসা যাক কুলাউড়ার প্রসঙ্গে। একটি মেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বিদেশে গিয়ে সে কি করেছে, কাকে বিয়ে করেছে, এ নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। কিন্তু  বাস্তবে তাই ঘটেছে। তার আচার-আচরণের দোহাই দিয়ে তার পরিবারকে হেনস্থা করার অধিকার রাষ্ট্রের সংবিধান কাউকে দেয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে মসজিদভিত্তিক পঞ্চায়েত বলে কিছু নেই। অথচ আলোচ্য ক্ষেত্রে তথাকথিত পঞ্চায়েত প্রধানরা মেয়েটির পরিবারকে একঘরে করার রায় দিয়েছে। স্থানীয় সরকারি প্রশাসনের যেখানে আইনের আলোকে বিষয়টি দেখার কথা, সেখানে কুলাউড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা উভয়পক্ষকে ডেকে মীমাংসার চেষ্টা করছেন বলে জানা যায়। এ প্রয়াস নিঃসন্দেহে আমার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার পরিচায়ক।

আসলে একটা দেশে গণতন্ত্র যখন দুর্বল হয়, স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে। আর এর সুযোগ গ্রহণ করে মৌলবাদের মতো অন্ধকারের শক্তি। বর্ণিত ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে বলে মনে করা যেতে পারে। গত এক দশক ধরে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারবিভাগসহ সবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের যে খেলা চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় কুলাউড়ার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর এসব আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি ছোটবেলায় শোনা গল্পের সেই গৃহস্থের মতো।

গল্পটা দিয়েই তাহলে শেষ করি।

গৃহস্থের ঘরে সিঁদ কেটে চোর ঢুকেছে। গৃহস্থ টেরও পেয়েছে। কিন্তু কিছু বলছে না। ভাবছে, দেখি চোর বেটা কি করে! এক এক করে ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। তা-ও সে কিছু বলছে না। ভাবছে, দেখি চোর বেটায় আর কি করে! চোরও কোনো বাধা না পেয়ে এক এক করে সব বের করে নিচ্ছে। গৃহস্থ তখনও ভেবেই চলেছে, দেখি বেটা আর কী করে! সব শেষে চোর যখন চলে যাচ্ছে, গৃহস্থ চিৎকার করে বললো, 'তোর ঘরে কি কিছুই নেই?'

গল্পের গৃহস্থের মতো আমরা আর কতকাল শুধু দেখেই যাবো? কত কাল ভাবতে থাকবো, দেখি বেটায় আর কী করে?

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা
moshtaque@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch a party by next Feb

Student leaders who spearheaded the July-August mass uprising are planning to launch a political party by early February 2025 and contest the next general election.

7h ago