ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে কীভাবে নিয়োগ হয়?

ইলাস্ট্রেশন: আনোয়ার সোহেল

প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে অডিটর নিয়োগের পরীক্ষা ছিল শুক্রবার। পরীক্ষা শুরুর আগেই এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেপ্তারও করে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) জানিয়েছে, একজন সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধি প্রশ্নফাঁসে জড়িত। গণমাধ্যমজুড়ে বড় করে আসে সেই সংবাদ। অথচ ডিবির সংবাদে সম্মেলনের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই সেই এমসিকিউ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো।

গতকাল রোববার প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলে জানা যায়, এই পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ১ হাজার ২০৭ জন। ফল প্রকাশের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ও সময় পরবর্তীতে ওয়েবসাইট ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে।

মৌখিক পরীক্ষার জন্য আলাদা কোনো প্রবেশপত্র দেওয়া হবে না। এমসিকিউ পরীক্ষার প্রবেশপত্রই মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এই ঘটনা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে রীতিমত প্রহসন। যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানায়, সেই পরীক্ষা বাতিল না করে কীভাবে নিয়োগের আয়োজন চলতে পারে? তাও আবার অডিটরের মতো পদের পরীক্ষা, যাদের কাজই হবে নানা জালিয়াতি ধরা। এখন তাদের নিয়োগই যদি জালিয়াতির মাধ্যমে হয় সেটা থামাবে কে?

ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়েছে, সেটা মহাহিসাব নিরীক্ষকের মহাপরিচালকে অবহিত করা হয়েছে। পরীক্ষা বাতিল করা বা আবার পরীক্ষা নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।

প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য ৭০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা ছিল গত শুক্রবার। গণমাধ্যমে আসা ডিবির ভাষ্য অনুযায়ী, অসদুপায় অবলম্বন করে কিছু চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন, এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে কাকরাইলের আবাসিক হোটেল থেকে শুক্রবার বিকেলে ২ পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র ও কাফরুলের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চক্রের ২ মূল হোতা মাহবুবা নাসরিন, মাহমুদুল হাসানসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৫টি ব্যাংকের চেক, ৭টি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১০টি স্মার্টফোন, ১৮টি প্রবেশপত্র, নগদ ২ লাখ টাকা ও ফাঁস হওয়া ৩ সেট প্রশ্নপত্র জব্দ করা হয়।

গত শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিনসহ চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার্থী সেজে কেন্দ্রে ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে প্রবেশ করেন।

পরীক্ষার হল থেকে ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন বাইরে পাঠানো হয়। বাইরে থাকা চক্রের সদস্যরা প্রশ্ন দ্রুত সমাধান করে আবার পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠান। এভাবেই প্রশ্নফাঁস করে এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করানো হয় চাকরি প্রার্থীদের।

পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১৬ লাখ টাকা চুক্তি করা হয়। ২ থেকে ৫ লাখ টাকা অগ্রিম হিসেবে দেন চক্রের সদস্যরা।

এভাবে জালিয়াতি করে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার পরও সেটার ফল প্রকাশ করা ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা।

অবশ্য প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও সেটা অস্বীকার করা বা ফল দেওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। কয়েকদিন আগেই খাদ্য অধিদপ্তরের উপ-খাদ্য পরিদর্শক পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্ন ও উত্তর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠে। তদন্তে নেমে অভিযোগের সত্যতা পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অথচ সেই পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হয়েছে।

আসলে প্রত্যেকবার প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে। সাংবাদিকতা জীবনে প্রশ্ন ফাঁসের বহু প্রতিবেদন করেছি যেখানে সব প্রমাণ থাকার পরেও কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে। এই তো গেল নভেম্বরেই রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের ১ হাজার ৫০০ অফিসার (ক্যাশ) পদের নিয়োগ পরীক্ষা হলো।

ওই দিন ছিল পরিবহন ধর্মঘট। বহু কষ্ট করে বহু অর্থ খরচ করে সারা দেশ থেকে ছেলে-মেয়েরা এসেছিলেন পরীক্ষা দিতে। কিন্তু সেদিনও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সেদিনও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতো অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব তথ্য-প্রমাণ হাজির করলে পরে সেই পরীক্ষা বাতিল হয়।

এখন যদি কেউ অভিযোগ করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত না করে কেন কর্তৃপক্ষ বলেছিল ফাঁস হয়নি? প্রায়ই এভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে এবং ঘটনার তদন্ত না করেই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলো বলে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আচ্ছা কী দৈবশক্তিতে তারা এত দ্রুত নিশ্চিত হন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি?

আমার বেশ মনে আছে, অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। ২০১৭ সালের ১৯ মে সকাল-বিকেল ২ বেলায় ওই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, সকালে পরীক্ষা শুরুর আগেই ব্যাপকভাবে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রটি আমি সেই সময়ে প্রথম আলো'য় দেওয়ার পরও সেই পরীক্ষা বাতিল করতে চাচ্ছিল না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এর আগে ওই বছরের ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়। অনুসন্ধান করে জানতে পারি, পরীক্ষা শুরুর আগের রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন এমন কয়েকজন বিষয়টা স্বীকারও করেন।

কিন্তু, ওই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিন্তু পরীক্ষা তো বাতিল হয় না। কাজেই এই পরীক্ষাও বাতিল হবে না। পরে অবশ্য ছেলে-মেয়েরা আদালতে গেলে সব প্রমাণ দেখে হাইকোর্ট পরীক্ষা বাতিলের নির্দেশ দেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এমন দায়িত্বহীন আচরণ করার ঠিক ৪ মাস পর ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করে সরকার।

প্রশ্ন হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সবসময়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে কেন? কারণটা অর্থনৈতিক। পিএসসি ছাড়া বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক চাকরি প্রার্থীর মেধা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশে কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। ফলে বেশির ভাগ নিয়োগ পরীক্ষা হয় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে।

আউটসোর্স মানে, নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নেবে আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, কোনো বিভাগ বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এ জন্য দরপত্র ডাকে। একেকটি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য দেড় থেকে ২ কোটি টাকা পায় বিভাগগুলো। আবার নিয়োগ মানেই দুর্নীতি। এসব কারণেই বোধহয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করতে চায় সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ।

অবশ্য সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেমে নেই। নানা সময়ে এসব চক্রের অনেককেই গ্রেপ্তারও করা হয়েছে; যেখানে সরকারি অনেক কর্মকর্তা ও ব্যাংকারসহ অনেকের তথ্য এসেছে। শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ এসেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে সরকারের নানা দপ্তরে চাকরি পেয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে হতাশায় ডুবেছেন চাকরিবঞ্চিত তরুণরা।

চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া কষ্টের। একেকটি পরীক্ষার জন্য আবেদন ফি হিসেবে কখনো ৫০০, ৭০০ বা ১০০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এসব পরীক্ষা হয় ঢাকায়। ফলে দুর্ভোগের শেষ নেই। এত কষ্টের পরও যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা শোনা যায়, তাহলে তরুণেরা যাবেন কোথায়?

এই মুহূর্তে দুটো সমাধানের কথা মাথায় আসছে। ব্যাংক বা সরকারি নানা নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠলেও বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা এখন আর শোনা যায় না। কী করে সেটা সম্ভব হলো? আমি নিজে এ ঘটনার সাক্ষী। পিএসসি বিসিএসের ৮ থেকে ১০ সেট প্রশ্নপত্র করে। পরীক্ষার আগমুহূর্তে লটারি করে সিদ্ধান্ত হয় কোন প্রশ্নে পরীক্ষা হবে। সব নিয়োগ পরীক্ষায় একই কাজ করা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় হলো, সরকারি নিয়োগের পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনা। পিএসসি যেমন এখন একটা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদেও নিয়োগ দেয়, তেমনি সারা বছরে কয়েকটি পরীক্ষা হতে পারে পিএসসির মাধ্যমেই।

সব ধরনের ব্যাংকের জন্য একটা, কারিগরি পদের জন্য একটা, সাধারণ পদের জন্য একটা—এমন করে বছরে ৫ থেকে ১০টা পরীক্ষা হতে পারে। সাধারণ নবম ও দশম গ্রেডের কর্মকর্তা পদ দিয়ে সরকারি চাকরি শুরু হয়। কাজেই সরকারের বিভিন্ন বিভাগ কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ৫ থেকে ১০টি পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ ও অপেক্ষমাণ তালিকা প্রকাশ করে রাখা যেতে পারে।

আবার শুধু কর্মকর্তা পদ নয়, কর্মচারী বা নিচের দিকের পদেও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে বছরে পদের ধরন অনুযায়ী জাতীয়ভাবে ৫ থেকে ১০টা নিয়োগ পরীক্ষা হতে পারে। এরপর অপেক্ষমাণ তালিকা বা প্যানেল করে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তাতে দুর্ভোগ কমবে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকিও কমবে।

আরেকটি বিষয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে। এই যে বারবার অস্বীকারের সংস্কৃতি, সে কারণেই প্রশ্নপত্র বেশি ফাঁস হয়। কাজেই যেকোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠান সেই প্রশ্নপত্র করেছিল তাদেরও কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদেরও দায় নিতে হবে। ফৌজদারি অপরাধে বিচার হতে হবে।

শুধু নিয়োগ পরীক্ষা নয়, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতেই হবে। দেশের তরুণ প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচাতে হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। আর সেই দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারির বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে সবাইকে।

শরিফুল হাসান: কলামিস্ট

Comments

The Daily Star  | English

Palak admits shutting down internet deliberately on Hasina's order

His testimony was recorded by the International Crime Tribunal's investigation agency following a questioning session held yesterday

45m ago