তেল চিনিতে কর কমছে, দাম কি কমবে?
তেল, চিনি ও ছোলাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। লক্ষ্য, আসন্ন রমজানে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা।
এমনিতেই গত কয়েকদিনে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি মানুষকে কষ্টে ফেলে দিয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বাদই দিলাম। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদেরও এখন সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। সরকার মানুষের সমস্যা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে বলেই ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন—এই শুল্ক প্রত্যাহারের সুফল জনসাধারণ পাবেন কি? সন্দেহ হয় কারণ, সরকারের খুব কম উদ্যোগেই শেষ পর্যন্ত জনগণ সুফল ভোগ করতে পারেন। পারলেও সেজন্য বড় অংকের খেসারত দিতে হয়। যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা না যায় তাহলে শুল্ক কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব কমবে ঠিকই, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
মানুষকে বেশি দামেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে হবে। বলছি না, সব ব্যবসায়ী অসাধু। তবে কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে যে দাম বাড়াচ্ছেন তা অসত্য নয়। তারা সংকট শুরুর আগেই সংকট তৈরি করে ফেলেন।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা স্থানীয় বাজারে দাম বাড়িয়ে দেন, যদিও তাদের কেনা পণ্যের দাম কম। উপরন্তু, তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করেন।
সন্দেহের আরও এক কারণ হলো অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন তেল, চিনি ও ছোলার ওপর ভ্যাট কমানো হবে। ছোলার ওপর কোনো কর নেই। তবে তেলের ওপর ভ্যাট কমানো হলে তার প্রভাব দামের ওপর পড়ার কথা। কতটা কমবে তা এখন দেখার বিষয়।
এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। সদিচ্ছার অভাবই আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রধানতম কারণ। অনেকে এটিকে আরও বেশি মুনাফার উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিএনপির ব্যবসায়ীদেরকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, যারা পণ্য মজুদ করে দাম বাড়াচ্ছেন তাদেরকে সরকার চিহ্নিত করতে পেরেছে। সরকারকে সাধুবাদ।
এখন প্রত্যাশা করবো দয়া করে তাদেরকে ধরুন, শাস্তির আওতায় আনুন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে মানুষ যে কষ্টে আছে তা থেকে তাদেরকে রক্ষা করুন। নতুবা অযথা একে অপরকে দোষ দিয়ে 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' চাপানোর কোন মানে নেই। যারা আসল দোষী তাদেরকে না ধরলে মানুষ ধরে নেবে যে তারা আপনাদেরই লোক।
এটা সত্য যে, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু, কোন পণ্যের দাম বেড়েছে এবং কতটা বেড়েছে তার বিপরীতে আমাদের দেশে কোন পণ্যের দাম কতটা বাড়লো তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
তাছাড়া, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারা তেলের দামের ট্যাগলাইন তুলে নতুন দাম বসালেন? কিংবা কারা বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করলেন? তা বের করতে রকেট সায়েন্স জানতে হয় না। তাহলে সরকার কেন তা বের করতে পারছে না? নাকি তারা ছোট ব্যবসায়ীদের ধরে তাদেরকেই দোষারোপ করতে চাচ্ছেন? কিংবা মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে চাচ্ছেন?
প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যদি মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে থাকেন তাদেরকে শাস্তি দিন। তবে যারা সত্যিকার অর্থেই বৃহৎভাবে দাম বাড়াতে কলকাঠি নাড়ছেন তাদেরকে না ধরলে সমস্যার সমাধান হবে না।
এ দিকে তেলের দাম নিয়েই দেশে মাতামাতি চলছে বেশি। তেলের দাম বৃদ্ধির আড়ালে আরও অনেক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। ভোক্তারা যখন বাজারে বা দোকানে যাচ্ছেন তখন তারা ঠিকই তা টের পাচ্ছেন।
যদি শুধু তেলের দাম বাড়তো আর অন্য পণ্যের দাম না বাড়তো তাহলে মানুষের কষ্ট এতটা হতো না। সুতরাং সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে ডিমের দাম কেন বাড়লো। পেঁয়াজের দাম কেন বাড়লো। সবজির দাম কেন বাড়লো। এমনকি ডায়াপারের দামও বেড়েছে। এর যুক্তি কী? এটা নিশ্চয়ই বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে বাড়েনি।
অর্থাৎ তেলের দাম বৃদ্ধির আড়ালে অনেকেই তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তেলের দাম হয়তো আগামীতে কমতে পারে কিন্তু প্যাকেটজাত বিভিন্ন পণ্যের দাম নিশ্চয়ই কমবে না। ফলে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করার সময় এসেছে।
প্রতি বছরই রমজান আসলে পণ্যবাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়। কেন? অনেকেই ভোক্তাদের দোষারোপ করেন যে তারা আগেভাগে পণ্য কিনে মজুদ করতে চান। তাই হঠাৎ বাজারে চাহিদার ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয়, যা দাম বাড়িয়ে দেয়।
আচ্ছা, আমাদের ব্যবসায়ীরা কি জানেন না যে প্রতি বছর রমজানে মানুষ কিছু পণ্য মজুত করতে চান। নাকি এটা নতুন ঘটনা। মানুষের চাহিদা বুঝেই তাদের পণ্য আমদানি করা দরকার। তবে একইসঙ্গে ভোক্তাদেরও এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
মানুষকে বুঝতে হবে রমজান ভোগের নয় ত্যাগের মাস। আর ব্যবসায়ীদেরকে বুঝতে হবে এ মাস 'ঝোঁপ বুঝে কোপ মারা'র জন্য নয়।
আহসান হাবীব, সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
Comments