তেলের দাম বৃদ্ধির যত ‘স্থূল’ বা ‘সূক্ষ্ম’ যুক্তি
'নজিরবিহীন' বাংলা ভাষার এই শব্দটির আলাদা করে আর কোনো তাৎপর্য থাকছে না। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একে একে সব নজিরই তৈরি হচ্ছে। নজিরবিহীন বলে আর কিছু থাকছে না।
তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত হাজারো সমস্যার বাংলাদেশে যা ঘটল, খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেদিকে একটু নজর দিলে 'নজিরবিহীন' বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। 'তেল ভারতে পাচার হয় বলে দাম বাড়ানো হলো', 'আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির ফলে দাম বাড়ানো হলো', 'বিপিসির লোকসান হয় বলে দাম বাড়ানো হলো' বিষয়ক কথামালা নিয়েও আলোচনার চেষ্টা করব।
৩ নভেম্বর বুধবার রাতে সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। বাস মালিকরা ৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ৫ নভেম্বর শুক্রবার থেকে ধর্মঘট কার্যকর হয়েছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষাকেন্দ্রে কীভাবে পৌঁছবেন, তা দেখার জন্যে একটি দেশে প্রশাসন বা সরকার আছে, তা বোঝা গেল না। আরও হৃদয়বিদারক বিষয় হিসাবে সংবাদটি সামনে এলো যে, শুক্র-শনিবার ছুটি থাকায় বাস মালিকদের সঙ্গে ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা রোববারের আগে হবে না। অর্থাৎ কমপক্ষে শুক্র-শনিবার পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। বাস মালিকরা জানিয়ে দিলেন, ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত বাস চলবে না। ট্রাক-লঞ্চেও ধর্মঘট চলতে থাকে। ভয়াবহ রকমের অমানবিক জনভোগান্তিতে সরকারের কোনো পর্যায়ের কারও মধ্যে কোনো সংবেদনশীলতা তৈরি হতে দেখা গেল না। ছুটির ২ দিনে কোনো আলোচনা নয়, কী বিস্ময়কর সরকারি নীতি আমরা দেখলাম। ছুটির ২ দিনে সরকারের কর্তারা তেলের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত দুর্বল 'স্থূল' বা 'সূক্ষ্ম' যুক্তি দিয়ে বক্তৃতা করে গেলেন।
৭ নভেম্বর রোববার মালিকদের চাওয়া অনুযায়ী সরকার ভাড়া বাড়িয়ে দিল। সন্ধ্যার পর সিদ্ধান্ত হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে ত্বরিতগতিতে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে গেল। শুক্র-শনিবার ছুটি, রাতও তো ছুটিরই অংশ। কিন্তু জনভোগান্তি সত্ত্বেও শুক্র-শনিবার আলোচনা হলো না, অথচ মালিকদের স্বার্থে রাতেই প্রজ্ঞাপন জারিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখা দিল না। ২৩ শতাংশ তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ৪০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিল সরকার। ৫০-৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের থেকে। যা দেখার কেউ নেই। অথচ ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ গণপরিবহনের জ্বালানি গ্যাস, ডিজেল নয়। দূরপাল্লার ট্রাকেরও একটা অংশ চলে গ্যাসে। শোনা যাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। তখন হয়ত আবার পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হবে এবং সেই বাড়ানোর মধ্যে ডিজেলচালিত পরিবহনও থাকবে।
সে কারণেই প্রশ্ন বা সিদ্ধান্ত এই যে, সরকার আসলে গুটিকয়েক মালিকের স্বার্থ দেখে, জনগণের নয়।
এবার আসি, ভারতে তেল পাচার প্রসঙ্গে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীর বক্তব্য বা সংস্থার ব্যাখ্যা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যভিত্তিক হওয়া প্রত্যাশিত। 'ভারতে তেল পাচার হয়' এই বক্তব্যের স্বপক্ষে তথ্য বা যুক্তি কী? সরকার কোনো সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছে?
এমন কোনো তথ্য কোথাও নেই। সীমান্তে বিজিবি বিশেষ করে বিএসএফের পাহারা এবং কাঁটাতারের বেড়ার ফলে তেল পাচার হওয়ার বিষয়টি মোটেই সহজ নয়। গরু চোরাচালান ঠেকানোর জন্যে বিএসএফ অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে থাকে। সীমান্ত এলাকার সংবাদকর্মীদের পর্যবেক্ষণ, বড় আকারে তেল পাচারের ঘটনা এখন ঘটে না। পাচার যদি কিছু হয়ে থাকে সেটা অতি সামান্য।
বেশ কয়েক বছর আগে ভারতীয় ট্রাক টাঙ্কি ভর্তি করে তেল নিয়ে যেত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে শুধু বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই পণ্য নিয়ে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ভারতীয় ট্রাক আসে। একেকটি ট্রাকের টাঙ্কির ধারণ ক্ষমতা ৩০০-৪০০ লিটার। টাঙ্কি খালি করে এসে ভরে নিয়ে চলে যেত। এই প্রক্রিয়ায় তেল পাচারও বন্ধ হয়ে গেছে। নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে সীমান্ত অঞ্চলের পেট্রোল পাম্পগুলো ভারতীয় ট্রাকের কাছে তেল বিক্রি করতে পারবে না। তাছাড়া ভারতীয় ট্রাকগুলো ডিপোর বাইরে বের হয়ে পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত আসতেও পারে না। সেই অনুমতি নেই। ড্রামে তেল নিয়ে ট্রাকের টাঙ্কিতে ভরবে, সেই সুযোগও নেই। নো-ম্যানস ল্যান্ডে বিজিবি প্রতিটি ভারতীয় ট্রাকের তেলের টাঙ্কি চেক করে। এত কিছুর পরেও হয়ত কিছু পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তার পরিমাণ কোনো বিবেচনাতেই এত বেশি না যে, তেলের মূল্য বাড়াতে হবে।
এবার আসি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য বেড়েছে এবং গত ৫ মাসে বিপিসির কত লোকসান হয়েছে তা জানিয়েছে। হিসাবটা এমন, প্রতি লিটার ডিজেলে জুন মাসে ২.৯৭ টাকা, জুলাইয়ে ৩.৭০ টাকা, আগস্টে ১.৫৮ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবরে মাসে ১৩.০১ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ কারণে জুন থেকে অক্টোবর ৫ মাসে বিপিসির লোকসান হয়েছে ১১৪৭.৫০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়া-কমা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৮৩.৫৪ ডলার। ধারণা করা হচ্ছে সামনে তেলের মূল্য আরও বাড়বে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় দৃষ্টিকটুভাবে কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়নি বা গোপন করা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছে, ২০১৬ সালে ডিজেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। গর্ব করে আরও জানিয়েছে, পরের ৫ বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল পর্যন্ত আর মূল্য বাড়ানো হয়নি।
এই ৫ বছর দাম বাড়াননি কেন বা বাড়ানোর কথা ছিল? বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত নীতি দাম বাড়ানো বা কমানো নয়, সমন্বয় করা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হবে, কমলে দেশেও কমানো হবে। ২০১৬-২০২০ এই ৫ বছর তেলের আন্তর্জাতিক বাজার কেমন ছিল? ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল তেলের গড় মূল্য ছিল ৪৩.২৯ ডলার। সে বছর তেলের সর্বনিম্ন মূল্য ২৬.১৯ ডলারও হয়েছিল। ২০১৭ সালে গড় মূল্য ছিল ৫০.৮০ ডলার, ২০১৮ সালে ছিল ৬৫.২৩ ডলার, ২০১৯ সালে ছিল ৫৫.৯৯ ডলার এবং ২০২০ সালে ছিল ৩৯.৬৮ ডলার। ২০২০ সালে একপর্যায়ে এক ব্যারেল তেলের দাম কমে সর্বনিম্ন ১১ ডলার হয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয়ের নীতি অনুসরণ করলে, দেশে তেলের দাম আরও অনেক কমার কথা ছিল। ঘোষিত নীতি অনুযায়ী দাম না কমিয়ে, এখন বলা হচ্ছে বাড়ানো হয়নি!
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ৮৩.৫৪ ডলার হওয়ায় বিপিসির লোকসান যদি প্রতি লিটারে ১৩.০১ টাকা হয়, তবে ২০২০ সালে এক ব্যারেল তেলের দাম যখন ৩৯.৬৮ ডলার ও সর্বনিম্ন ১১ ডলার হয়েছিল, বিপিসি তখন প্রতি লিটারে কত টাকা লাভ করেছিল? সেই হিসাব জ্বালানি মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেনি।
বুয়েটের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ম. তামিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে অকটেনের দাম বাড়েনি, কিন্তু দেশে বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকা লিটার। এই তেলের আমদানি মূল্য হয়তো ৪০-৪৫ টাকা। এর সঙ্গে নির্ধারিত ভ্যাট, ডিউটি, ট্যাক্স ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি প্রায় ৩০ টাকা। সরকার চাইলে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি করতে পারে। কিন্তু এখানে সরকার উল্টো আরও লাভ করছে।'
সরকার জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বা লোকসানের কথা বললেও, এখনও প্রতি লিটার অকটেনে লাভ করছে ১৫-২০ টাকা।
২০১৪ সাল থেকে গত ৭ বছরে বিপিসি তেল বিক্রি করে মোট লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরে প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলে ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট পায় সরকার। ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট মানে লিটার প্রতি ১৯ টাকা পায় সরকার।
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেছেন, বিপিসির লাভের বাইরে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ প্রতিবছর সরকার পায় ৯-১০ হাজার কোটি টাকা। সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স নেবে, প্রশ্ন সেটা নিয়ে নয়। প্রশ্ন বিপিসি যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভ করল, সেই টাকাও সরকার নিয়ে নিয়েছে। লাভের টাকার কিছু অংশও যদি বিপদের দিনে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে ভর্তুকি দেওয়া হবে, এই নীতিতে জমা করে রাখা হতো তবে এখন তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। কিন্তু 'উন্নয়ন' প্রকল্পে ব্যয়, অপব্যয় বা দুর্নীতির মাধ্যমে এই টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে। সরকার ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে। জনগণের কাছে তেল বিক্রি করে লাভ করছে। সরকারের তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিপিসির কার্যক্রম অস্বচ্ছ। তারা কত দামে তেল কেনে, পরিবহন খরচ কত, সেই হিসাব স্বচ্ছ নয়। তাদের বিরুদ্ধে বড় আকারের দুর্নীতির অভিযোগ আছে। তারও দৃশ্যমান তদন্ত হয় না। সরকার শুধু তেলের দাম বাড়িয়ে লাভ করার মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান দেখে। জনগণ সরকারের ভাবনায় নেই।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে দরিদ্র বেড়েছিল প্রায় আড়াই কোটি। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সোয়া ৩ কোটিরও বেশি। তাদের জন্যে সরকারের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অত্যধিক মাত্রায়। এখন ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়ল। বাড়ল পরিবহন ভাড়া। যার প্রভাব পড়বে জীবনযাপনের সর্বত্র। মানুষ কীভাবে বাঁচবে, তা দেখা বা চিন্তার করার কেউ নেই।
s.mortoza@gmail.com
Comments