ঝুমন দাশ ও প্রশ্নবিদ্ধ রাষ্ট্রের মানবিকতা

আমাদের প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে কোর্ট আর ডিফেন্স নিয়ে রিপোর্টিং বা লেখালেখিতে এক ধরনের ট্যাবু ছিল। শুরুতেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিভাগ থেকে নিরাপদ দূরে থাকার জন্য সতর্কবাণী দিয়ে বলা হতো, জাতীয় সংসদ ছাড়া এই দুই বিভাগ নিয়ে টু শব্দ করার সুযোগ কারো নেই।
jhumon_das_3sep21.jpg
ঝুমন দাশ আপন। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে কোর্ট আর ডিফেন্স নিয়ে রিপোর্টিং বা লেখালেখিতে এক ধরনের ট্যাবু ছিল। শুরুতেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিভাগ থেকে নিরাপদ দূরে থাকার জন্য সতর্কবাণী দিয়ে বলা হতো, জাতীয় সংসদ ছাড়া এই দুই বিভাগ নিয়ে টু শব্দ করার সুযোগ কারো নেই।

প্রকৃত অর্থে এটা ছিল এডিটর বা নিউজ এডিটরদের সেলফ সেন্সর। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে দীর্ঘ স্বৈরশাসন ছিল। সংবিধান স্থগিত হয়েছে অসংখ্যবার। হয়তো এসব কারণে আমাদের অগ্রজরা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবিধান নিঃশর্তভাবে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দিয়েছে। আইনের ধারা শর্ত সাপেক্ষ হলেও সংবিধান বহাল থাকাকালীন বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও আছে। সামরিক বিভাগ এবং বিচার বিভাগ আইনের ঊর্ধ্বে কোথাও বলা হয়নি।

বর্তমানে ডিফেন্স ট্যাবু থেকে ঢাকার সাংবাদিকতা বেরিয়ে এসেছে। তবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশ্ন জড়িত থাকলে সবাই সেটাকে গুরুত্ব দেয়, যা দেশ প্রেম ও দায়িত্ববোধের অংশ।

এ দেশের সাংবাদিকতায় এখনো আদালত ট্যাবু আছে। বিচার বিভাগ বিশেষ করে বাংলাদেশর সুপ্রিম কার্ট এখনো জনগণের আস্থার জায়গা। বিচার বিভাগের সুনাম ক্ষুণ্ন বা অবমাননা হয় এমন কোনো রিপোর্ট বা লেখালেখি উচিত কি অনুচিত ভেবে আমরাও অনেক বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি। উচ্চ আদালত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের জায়গা আমাদের। তবুও কিছু কিছু প্রশ্ন থাকে যা নাগরিক হিসেবে করা যেতে পারে।

কোনো আদালতের সিদ্ধান্তে নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব হলে সেটাকে চ্যালেঞ্জ করতে উচ্চ আদালতে গেলে সব সময় ন্যায়বিচার পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষ তা বিশ্বাস করেন।

যে অধিাকরের প্রশ্নে নিম্ন আদালতর রায়কে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়া যায়, সেই একই অধিকার নিয়ে সংবাদপত্রে আলোচনার সূত্রপাত করতে কি আইনগত বাধা আছে? যদি নিম্ন আদালতের রায় আইনসম্মত না হয় এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আপিল করেন তাহলে একই বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি কি আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়বে, যদি আদালতকে অযাচিত আক্রমণ বা অসম্মান করা না হয়?

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা দেশের অনেক মানুষকে আহত করেছে। সুনামগঞ্জের শাল্লাহ'র ঝুমন দাশের অপরাধ কী? তিনি ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল গংদের সন্ত্রাস নৈরাজ্য নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এর ফলে মামনুলের উগ্রবাদি ভক্তরা হবিবপুর ইউনিয়নের নওগাঁও গ্রামে হামলার পরিকল্পনা করে যা স্থানীয় পুলিশের আগে থেকেই জানা ছিল। সম্ভাব্য হামলা থেকে বাঁচতে গ্রামবাসীই ঝুমন দাশকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আগাম সব তথ্য থাকার পরও হামলা ঠেকানোর ব্যবস্থা না নিলেও পুলিশ ঝুমন দাসকে প্রথমে ৫৪ ধারায় আটক দেখায়। তারপরও নওগাঁও গ্রামের সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়িতে মামুনুলের ভক্তরা হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। এই হামলার ঘটনায় প্রমাণিত হয় ঝুমন দাসের ফেসবুক পোস্ট অসত্য ছিল না। তবুও পরবর্তীতে পুলিশই ঝুমন দাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পাঁচ দিন পর। ঝুমনকে মুক্ত করতে গত পাঁচ মাসে সাত বার জামিনের আবেদন করা হয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জজকোর্ট ও হাইকোর্টে। সব আদালতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বি না বিচারে ঝুমন দাশকে কত দিন কারাগারে থাকতে হবে তা উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানেন না। অথচ ঝুমনের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দিতে পারেনি এখনো।

ঝুমনকে হেফাজতে নেওয়ার পর নওগাঁও গ্রামে হামলা চালানো হয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে মামুনুলসহ তার অনেক সহযোগীকে সরকার গ্রেপ্তার করে। এতেও প্রমাণিত হয় মামুনুলকে নিয়ে ঝুমন দাশের ফেসবুকে দেওয়া পোস্টের তথ্য সম্পূর্ণ সঠিক।

৫৪ ধারায় প্রথমে আটক করলেও সুনামগঞ্জ পুলিশ পাঁচ দিন পরে ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে বিতর্কিত এই আইনের চরম অপব্যবহার করে। বিনা বিচারে পাঁচ মাস ধরে ঝুমন দাশের মতো একজন নিরীহ মানুষ কারাভোগ করছেন। ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টের কারণে গ্রেপ্তার ঝুমনের জামিন সাত বার প্রত্যাখ্যানই প্রমাণ করে রাষ্ট্র কতটা অমানবিক আচরণ করছে তার সঙ্গে। অথচ ঝুমন দাশদের গ্রামে হামলাকারীদের মধ্য থেকে গ্রেপ্তার ৫২ জনই জামিনে বের হয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবুও আমরা আদালতের কার্যক্রম নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবো না। আমাদের শেষ ভরসার জায়গা আদালত এখনো অনেক মানবিক। তারাই নির্বাহী বিভাগকে মানবিক করে তুলতে চাপে রাখবেন, প্রত্যাশা রাখি।

একেবারে নতুন ঘটনা। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ চিত্রনায়িকা পরীমনির জামিন শুনানি দীর্ঘ দিনের জন্য ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কদিন পরের একটি তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন জামিন শুনানির। হাইকোর্ট এই জামিন শুনানিকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টাকে আইনসম্মত মনে করেননি এবং এই প্রক্রিয়াকে কোনো বেআইনি ঘোষণা হবে না এবং অবিলম্বে পরীমনির জামিন শুনানি কেন করা হবে না জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ১ সেপ্টম্বরের মধ্য জবাব দেওয়ার জন্য নিম্ন আদালতকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।

তড়িঘড়ি করে ১ সেপ্টেম্বরের আগেই মহানগর দায়রা জজ পরীমনির জামিন শুনানির দিন এগিয়ে আনেন ৩১ আগস্টে। একইদিনে আদালত পরীমনিকে জামিনও দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় জনমনে প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট কারণ আছে যে, মহানগর দায়রা জজ প্রকৃত অর্থে উচ্চ আদালতের রুলের জবাব এড়িয়েছেন। এতে কি প্রমাণিত হয় না যে মহানগর দায়রা জজ আদালতে পরীমনির জামিন শুনানি দীর্ঘায়িত করার একটা চেষ্টা হয়েছিল? কারা করেছিল? সংবাদমাধ্যম যদি এই প্রশ্ন উত্থাপন করে আদালতের অবমাননা হবে কি?

পরীমনির মামলাকে হাই প্রোফাইল মামলা বলা যায়। শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এই মামলা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল। পরীমনিকে আদালতে আনা-নেওয়ায় পুলিশের যে বিশাল বহর এবং সংবাদমাধ্যমের বিপুল সংখ্যক সদস্যের কোর্টে উপস্থিতি এই মামলাকে হাই প্রোফাইল বানিয়ে দেয়। অবশ্য সমাজের একটা সচেতন নাগরিক গোষ্ঠী পরীমনির ন্যায় বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। দেশের প্রতিথযশা ১৭ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তার জন্য সুবিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সমিতি নামের সাংস্কৃতিক দোকানের আইডি কার্ডধারী হাজার হাজার পারফরমারের ভিড়ে এখনো প্রকৃত শিল্পী আছেন। তাদের সংখ্যা হাতে গোনার মতো।

এ রকম একটি হাই প্রোফাইল মামলার অভিযুক্ত অভিনেতাকে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে হেনস্থা করা হলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কি ঘটে অনুমান করা যায়। সংবাদমাধ্যমসহ সাধারণ জনগণের মধ্যে পরীমনির জন্য সিমপ্যাথি তৈরি হয়েছিল। কারণও আছে। নর্মামস্টগ সিন্ড্রোমে যেখানে মারাত্মক অপরাধীর জন্য ভিকটিমের আবেগ তৈরি হয়, সেই অর্থে পরীমনির বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগই আনতে পারেনি দফায় দফায় তদন্ত সংস্থা বদল করেও। তারা দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়েও যুত্সই কোনো অপরাধের অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি। আর এতেই বেশিরভাগ মানুষের সিমপ্যাথি পেয়েছেন তিনি।

মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শত শত ঘটনা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘটে। যারা পরীমনির মতো মিডিয়ার ফোকাসে থাকে না, তারা যেকোনো ধরনের অমানবিকতার শিকার হলে জনগণের নজরেও আসে না। গোপন থেকে যায়। যেমনটি আসেনি লেখক মুশতাক আর কার্টুনিস্ট কিশোরের মামলার জামিনের দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়টি। হেফাজতে মুশতাক মারা না গেলে হয়তো কোনোদিন প্রকাশ্যেও আসতো না তাদের জামিন কত দীর্ঘায়িত হয়েছে। তাদের সঙ্গে রাষ্ট্র কত অমানবিক আচরণ করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে ফটো সাংবাদিক কাজলের সঙ্গে। এই নির্যাতিতদের তালিকা কেবল লম্বা হচ্ছে। ঝুমনও সেই তালিকার একজন হতভাগা নম্বর।

পরীমনির মামলায় গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, বিচারিক আদালত (সিএমএম কোর্ট) অভিযুক্তকে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেননি— যা শুধু নজিরবিহীনই নয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলছেন আইনজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে যদি কোনো সংবাদমাধ্যম, সিনেমায় বা কোনো গণমাধ্যম প্রশ্ন তোলে আদালত অবমাননা কি হবে? প্রশ্ন উত্থাপন করলে আদালত কি ডেকে পাঠাবেন তাকে?

সর্বশেষে দেশের একজন করদাতা নাগরিক, চলচ্চিত্র কর্মী হিসেবে আমি ঝুমন দাসের মামলা প্রত্যাহার ও অবিলম্বে তার নিঃশর্ত মুক্তি চাই। সত্যিকার ভিকটিম কারগারে আর হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের মুক্ত জীবনযাপন নওগাঁও গ্রামের নির্যাতিতদের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে।

আর একটা প্রশ্ন করে লেখাটা শেষ করতে চাই। শনিবার বিকেলের মতো বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে, মৌলবাদিদের খুশি করে যারা ভেবেছিলেন দেশের ভাবমূর্তি একেবারে আকাশ ছোঁয়াবেন তাদেরকে বিনীতভাবে ভাবতে অনুরোধ করছি, ঝুমন দাশের বন্দি এবং শাল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরে হামলায় দেশের ভাবমূর্তি কোথায় ঠেকেছে?

জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা

jahmed@glbangladesh.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
PM Sheikh Hasina

Govt to seek extradition of Hasina

Prosecutors of the International Crimes Tribunal have already been appointed and the authorities have made other visible progress for the trial of the ones accused of crimes against humanity during the July students protest

34m ago