‘ঘর বানাইলা কী দিয়া!’

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে তৈরি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ১১টি ঘর জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের জন্য পাকা ঘর নির্মাণের অসাধারণ একটি উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু মুজিববর্ষে অসহায় মানুষের উপহার হিসেবে দেওয়া এসব ঘর নিয়ে এখন নানা অভিযোগ উঠেছে।

বসবাস শুরুর আগেই কোথাও ঘরে ফাটল দেখা গেছে, কোথাও আবার দেওয়াল ধ্বসেই গেছে। কোথাও বৃষ্টির পানিতে ঘর ডুবে গেছে, আবার কোথাও ঘরের নিচ থেকে মাটি সরে ধ্বসে পড়েছে। সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের এই অবস্থা কেন? কেন এক টুকরো লোহা ছাড়াই একটা পাকা ঘর বানানো হলো?

সাদা চোখে দেখলে খুব সহজ করে বলা যায় দুর্নীতি হয়েছে। বলার কারণও আছে। কারণ এই দেশে ১০০ টাকার জিনিস এক লাখ টাকা বিল দেখানো হয়, আর রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলে দুর্নীতি। কিন্তু একেকটা পাকা ঘর নির্মাণের বাজেট কতো ছিল আপনারা কী কেউ জানেন?

শুনে বিস্মিত হবেন, প্রথম পর্যায়ের একেকটা ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল মাত্র এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। সঙ্গে পরিবহন ব্যয় চার হাজার টাকা। এবার বলেন, এক লাখ ৭১ হাজার টাকায় কী করে টেকসই পাকা ঘর হয়? তাও সারা দেশে একই নকশায় একই খরচে?

আচ্ছা যে প্রকৌশলীরা এই বাড়ির নকশা করলেন, তারা কী ভেবেছিলেন আদৌ এক লাখ ৭১ হাজার টাকায় পাকা ঘর নির্মাণ সম্ভব কী না! তাও সব জায়গায় একই বাজেটে? কারণ, বাংলাদেশের একেক এলাকার মাটি একেক রকম। বর্ষায় পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বস হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হয়। উত্তরাঞ্চলে বন্যা হয় নিয়মিত। তাহলে সারা দেশে এক নকশা, এক বাজেট করলে কীভাবে টেকসই ঘর হবে? মাটি ভরাটের জন্য এলাকাভেদে ভিন্ন বাজেট ও সময় দিতে হবে না?

আশ্রয়ণ প্রকল্পের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ১৯৮৮ সালের বন্যার বিপৎসীমার ওপর পর্যন্ত মাটি ভরাট করে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভিটি প্রস্তুত নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটা কী করা হয়েছে?

গৃহহীনদের জন্য এই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে খাসজমিতে। একটা এলাকার খাস জমি কোথায় পড়ে থাকে? যেখানে নিচু এলাকা, যেখানে কেউ যেতে চায় না। আচ্ছা এইসব এলাকায় ঘর করতে হলে তো মাটি ভরাট করতে হবে। মাটি ভরাটের পর মাটি শক্ত হতে সময় দিতে হবে। কিন্তু সেই সময় ও অর্থ কী দেওয়া হয়েছে? নভেম্বর মাসে বরাদ্দ দিয়ে জানুয়ারি মাসে ঘর চাইলে কীভাবে টেকসই হবে? ফলাফল, বৃষ্টিতে ঘরের নিচের মাটি সরে গেছে।

এবার ঘরের নকশার দিকে তাকান। প্রকৌশলীরা নকশা বানালেন, ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থের ঘর হবে। ভেতরে থাকবে দুটি কক্ষ, থাকবে রান্নাঘর ও শৌচাগার। এই ঘর নির্মাণে ছয় হাজার ইট, ৫০ বস্তা সিমেন্ট, ২০০ ঘনফুট বালু এবং ভিটা নির্মাণে ৫০ ফুট বালু ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু লোহা কোথায়?

বিস্ময়কর! এমন একটি পাকা ঘর নির্মাণে যদি লোহার এতোটুকুও ব্যবহার না থাকে সেই ঘর কী করে টিকবে? আশঙ্কার বিষয়, এখনও যতো ঘর ধসেছে সামনে তো আরও ধসবে।

আরেকটি বিষয়। এই প্রকল্পে যেখানে অনেকগুলো ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে যদি বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য ড্রেনেজ নির্মাণ না করা হয়, তাহলে কিন্তু অতি বৃষ্টিতে ভূমি ক্ষয় হয়ে ভূমিধ্বস হবে এবং ঘর পড়ে যাবে। ইতোমধ্যে সেটিও শুরু হয়েছে।

আচ্ছা একটা উন্নয়ন কাজে কেন এতোসব সংকট হলো? উন্নয়ন যোগাযোগ নামে একটা কোর্স পড়াচ্ছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছর ধরে। সেখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে—টপ ডাউন এপ্রোচ আর বটম আপ অ্যাপ্রোচ। একটা ডমিন্যান্ট প্যারাডাইম আরেকটা পার্টিসিপেটরি। মানে একটায় উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আরেকটায় সবার মতামত নিয়ে সবার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে করা হয়। উন্নয়ন টেকসই করতে আজকাল দ্বিতীয়টার কথাই বলা হয়।

উদাহরণ দেই। ধরেন পাঁচ তারা হোটেলে বসে আপনি ঠিক করে ফেললেন বস্তিতে স্কুল করে সবাইকে লেখাপড়া করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি সেখানকার মানুষের কথাও না শুনে একটা দারুণ স্কুল করে ফেললেন। কিন্তু দেখা গেল সেই স্কুলে কেউ আসে না। কারণ তাদের পেটে ভাত নেই। এ কারণেই বলা হয়, যাদের জন্য উন্নয়ন তাদের সঙ্গে কথা বলা। আগে প্রয়োজনটা বোঝা দরকার।

কেন জানি মনে হয়, পাকা ঘর নির্মাণের বিষয়টায় উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য এক লাখ ৭১ হাজার টাকায় দারুণ এক ঘরের ভাবনা সবাই উপর থেকে খালি চাপিয়েছেন। সচিব সাহেব চাপিয়েছেন অতিরিক্ত সচিবকে, তিনি নিচের দিকে। ডিসি সাহেব আবার চাপিয়েছেন ইউএনওকে। কিন্তু ঘর নির্মাণের কাজটা যে ইউএনওরা করেছে তারাই বুঝেছে সমস্যাগুলো কোথায়?

কিন্তু ইউএনও কেন চাপিয়ে দেওয়াটা মেনে নিলেন? কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এটা নিয়ে আপনারা কিছু বলেননি? কেন বলেননি এই টাকায় টেকসই পাকা ঘর করা কঠিন? আর আপনারা তো প্রকৌশলী নন। আপনারা বুঝবেন কী করে কোন মানের ঘর হচ্ছে? কীভাবে তদারকি করবেন? আপনারা ইট-বালু-সিমেন্ট-রড চেনেন ভালো করে?

উত্তরে বেশ কয়েকজন বলেছেন, তাদের আসলে এসব নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগই ছিল না। ডিসি স্যাররা তাদের চাপে রেখেছেন। ডিসি স্যারদের নিশ্চয়ই চাপে রেখেছেন সচিবরা।

আরেকটি বিষয়- জনপ্রিয়তা। প্রশাসন ক্যাডারের উঁচু থেকে নিচু সবাইকে আসলে জনপ্রিয়তার রোগে পেয়েছিল। তারা ভেবেছিল এই কাজ করে তাক লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু যে কাজ আপনি করতে পারবেন না সেই কাজ আপনি করতে যাবেন কেন? একজন ইউএনও নিশ্চয়ই ঘর বানানোর বিষয়টা একজন প্রকৌশলীর মতো করে বুঝবেন না।

উপজেলাগুলোতে এই ঘর বানানোর জন্য উপজেলায় পাঁচ সদস্যের একটা কমিটি ছিল। ইউএনও ছিলেন তার আহ্বায়ক। পৃথিবীতে আর কোথাও প্রকৌশল বিষয়ক একটা কমিটিতে ইউএনওকে প্রধান করা হয়েছে কী না জানা নেই! কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। এই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বা পিআইও। বুঝুন অবস্থা।

অথচ ঘর নির্মাণের কাজটা কিন্তু এতো সহজ ছিল না। ধাপে ধাপে বহু কাজ। ঘরহীন মানুষ বাছাই, যাচাই, খাসজমি ঠিক করা, এরপর ঘর নির্মাণের নানা ধাপ। আর সকাল-বিকেল রিপোর্ট পাঠানো তো আছেই। একজন ইউএনও উপজেলার নানা কাজ করে কীভাবে এই ঘর নির্মাণের কাজ তদারকি করবেন, সেটাই প্রশ্ন। তারপরেও তারা হয়তো অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজটি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফলাফল— এখন ভয়ে আছেন কখন কোন ঘর ভেঙে পড়ে, আর কখন কে ওএসডি হন। কিন্তু এই দায়িত্ব তাদের কেন দেওয়া হলো?

কথা হলো এখন সমাধান কী? এমন সুন্দর একটা প্রকল্প কী মাঠে মারা যাবে? আড়াই লাখ গৃহহীনের জন্য যে আশ্রয়ণ প্রকল্প সেটি টেকসই করার উপায় কী?

প্রকল্পটিকে টেকসই করার কথা আসছে এই কারণে যে, প্রথম পর্যায়ে দেশের প্রায় ৫০০ উপজেলার ৬৬ হাজার পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আরও এক লাখ পরিবারকে ঘর দেওয়ার পরিকল্পনার কথা সরকার জানিয়েছে। ছোট্ট এসব ঘর ঘিরে একেকটি পরিবারের স্বপ্ন গড়ে উঠেছে।

কোনো সন্দেহ নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে অনেক হতদরিদ্র পরিবারের। কারও কারও নৌকা–জীবনের অবসান হয়েছে। অনেকে খুঁজে পেয়েছেন ঠিকানা। কিন্তু ঘরগুলো যদি টেকসই না হয়, তাহলে তো তাদের সেই স্বপ্নও ভেসে যাবে। গরিব মানুষের জন্য করা এমন একটি প্রকল্প কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেওয়া উচিত না।

সরকারের নীতি নির্ধারকদের তাই বলবো, ইতোমধ্যে যেসব অনিয়ম হয়েছে সেগুলোর তদন্ত করুন। কেউ দুর্নীতি করেছে এমন খোঁজ পেলে শুধু ওএসডি কেন আরও শক্ত ব্যবস্থা নেন। পাশাপাশি ভুলগুলোও চিহ্নিত করুন। নতুন করে কৌশল ঠিক করুন। যেসব ঘর এখনও নির্মাণ হয়নি সেগুলো আগের নকশায় না করে নকশা পরিবর্তন করে ও বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে টেকসই ঘর নির্মাণ করুন।

বেশ কয়েকজন ইউএনওকে জিজ্ঞাসা করেছি, যে নকশা দেওয়া হয়েছে কতো টাকা হলে এই নকশায় একটা মোটামুটি টেকসই ঘর হয়। অনেকেই বলেছে, অন্তত আড়াই লাখ টাকা। এর আগে এই টাকায় দুর্যোগ সহনীয় ঘর করা হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বেই। সেগুলো নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই।

অবশ্য দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘর করার জন্য এক লাখ ৯০ হাজার টাকা ও পাঁচ হাজার টাকা পরিবহন খরচ দেওয়া হচ্ছে। এই খরচটা অন্তত আড়াই লাখ বা বাস্তবতা যাচাই করে বাড়ানো হোক। দেখেন, এই দেশে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকায় নানা ক্যাটাগরিতে রাজউকের প্লট দেওয়া হয়। সেই প্লটের দাম কোটি টাকা। তাহলে গরিব মানুষের জন্য একটা ঘর করতে কেন প্রয়োজনীয় টাকা খরচ হবে না?

আর মুজিববর্ষে এতো বড় একটা প্রকল্প হচ্ছে, তার মনিটরিংয়ের জন্য আলাদা প্রকৌশলী কোথায়? কাগজে কলমে এই প্রকল্পে নানা কমিটি থাকলেও কাজ দেখতে কয়জন গেছেন? গেলে তো তারা ধ্বসে যাওয়ার আগেই ত্রুটি ধরতে পারতেন। আর ইউএনওদের তো এসব কারিগরি জ্ঞান নেই। কাজেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রকৌশলীদের নিয়ে একাধিক টিম গঠন করা হোক। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তদারকি করুন, ভুল খুঁজে বের করুন। তবুও ঘর বানানোর কাজটা ভালো করে চলুক।

আরেকটা বিষয়, শুধু ঘরে থাকলেই তো চলবে না। এই ঘরে থাকার পাশাপাশি তারা যেন কোনো না কোনো কাজ বা আয় করতে পারেন সেটাও তো নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে না হয় হাসি ফুটুক কয়েক লাখ অসহায় মানুষের মুখে। ভূমিহীন ঘরহীন মানুষের একটা ঠিকানা হোক। শুধু যেন প্রশ্ন না ওঠে, ঘর বানাইলা কী দিয়া?

 

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

shariful06du@gmail.com

Comments