কেন এই অবিশ্বাস?

আমরা এখন এক বিশ্বাস-শূন্যতার সময়ে বাস করছি। ব্যক্তি থেকে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সর্বক্ষেত্রেই অবিশ্বাসের দাপট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে হাজারো আপত্তি। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে দ্বিধা। মনে হয় আমি বুঝি ভুল দেখছি, কিংবা যা দেখছি তা ভুল। তাই হয়তো ইতিহাসের চেয়ে শ্রুতিকথা এখন বেশি গ্রহণযোগ্য। রাজনীতির ক্ষেত্রে এই অবিশ্বাস আরও বেশি প্রকট। যত সত্যিই হোক না কেন, ভিন্ন মতাবলম্বীর কোনো কথাকেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। বরং সত্যটাকে অবিশ্বাস করার জন্য নিজের মতো করে যুক্তি দাঁড় করাতে সবাই আমরা সচেষ্ট।
ছবি: রাশেদ সুমন

আমরা এখন এক বিশ্বাস-শূন্যতার সময়ে বাস করছি। ব্যক্তি থেকে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সর্বক্ষেত্রেই অবিশ্বাসের দাপট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে হাজারো আপত্তি। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে দ্বিধা। মনে হয় আমি বুঝি ভুল দেখছি, কিংবা যা দেখছি তা ভুল। তাই হয়তো ইতিহাসের চেয়ে শ্রুতিকথা এখন বেশি গ্রহণযোগ্য। রাজনীতির ক্ষেত্রে এই অবিশ্বাস আরও বেশি প্রকট। যত সত্যিই হোক না কেন, ভিন্ন মতাবলম্বীর কোনো কথাকেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। বরং সত্যটাকে অবিশ্বাস করার জন্য নিজের মতো করে যুক্তি দাঁড় করাতে সবাই আমরা সচেষ্ট।

সম্প্রতি কুমিল্লায় হিন্দুদের পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব বাধানোর অভিযোগে ইকবাল নামে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। সে নাকি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমসহ মূলধারার সকল সংবাদপত্রেই এই খবর এসেছে। খবরে বলা হয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ইকবালকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেই ফুটেজও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। এ কথা সবাই জানে যে সিসিটিভি একটা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। কিন্তু তারপরও মানুষের মাঝে এ নিয়ে সন্দেহ। শুধু সন্দেহই নয়–এর সঙ্গে অবিশ্বাসও কাজ করছে। দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ মনে করছে অতীতের অনেক কাহিনীর মতো এটিও একটি সাজানো নাটকের অংশ। যারা অবিশ্বাস করছে কিংবা বিশ্বাস করতে পারছে না, তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের মতো করে যুক্তিও দাঁড় করাচ্ছে। প্রশ্ন তুলছে সিসিটিভির কার্যকারিতা নিয়েও।

কিন্তু কেন? কেন সবকিছুতে এই বিশ্বাসহীনতা? এ কি কেবলই কোন অপপ্রচারের ফল, নাকি এর পেছনে আরও বৃহৎ কোন কারণ আছে? আমার মনে হয় সময় এসেছে তা খুঁজে বের করার। তবে এ কথা মানতেই হবে এই যে অবিশ্বাস এ তো আর একদিনে জন্ম নেয়নি। এর পেছনেও অনেক কারণ আছে। মনে আছে নিশ্চয়ই—সেই ২০০৪ এ আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হলো। গা শিউরে উঠা সেই হামলায় দুই ডজনের মতো প্রাণ ঝরে গেল। আহত হলেন আরও অনেকে। সেসময়কার বিরোধী দলীয় নেত্রী—বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানব ব্যূহ তৈরি করে কোনোমতে রক্ষা করল তার দলের নেতাকর্মীরা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তোলপাড় শুরু হলে হামলার রহস্য উদঘাটনে ধরে আনা হলো এক তরুণকে। এই প্রথম শোনা গেলো তার নাম—জজ মিয়া। এদেশে বিশ্বাস হত্যার নাটকের সেটাই শুরু। আদালতে স্বীকারোক্তিও দিলো জজ মিয়া। আদালতে স্বীকারোক্তি মানে বিচারকের সামনে সত্য প্রকাশ। তাই একে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না, যদিও শুরু থেকেই বোদ্ধামহল সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন এই তদন্তের গতি-প্রকৃতি নিয়ে। সময় বদলানোর পর জানা গেল জজ মিয়া ছিল এক নাটকের নাম। বিচার গড়াল অন্য দিকে। উন্মোচিত হলো নতুন সত্য। মাঝখান দিয়ে বেচারা জজ মিয়ার জীবন থেকে হারিয়ে গেল অনেকগুলো বছর।

২০০৪ তে সেই যে শুরু! তারপর গল্পে গল্পে কেটে গেছে ষোলটি বছর। কিন্তু একই গল্প যখন চরিত্র আর স্থানের নাম বদলিয়ে বারবার বলা হয়—হোক তা ক্রসফায়ারের গল্প কিংবা কারো বাসা থেকে মাদক বা অস্ত্র উদ্ধারের গল্প—তাতে সন্দেহ জাগতে বাধ্য, যা প্রকারান্তরে বিশ্বাসের ভিতে ফাটল ধরিয়ে বিশ্বাসহীনতার দিকেই মানব মনকে ধাবিত করে। তা-ই ঘটল। দেশের ক্ষমতার হাতবদল হলো। কিন্তু নাটকের স্ক্রিপ্ট বদলাল না। এ ঘটনা—ওই ঘটনা—সবক্ষেত্রেই চলল জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি। ২০০৪ সালে ক্রসফায়ার শুরুর পর থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৩৮৮০ জন মানুষ র‍্যাব কিংবা পুলিশের 'ক্রসফায়ারে' মারা গেলো। (সূত্র দৈনিক সংবাদ, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০)। এই প্রত্যেকটি মৃত্যুরই প্রায় একই গল্প—ধরা পরার পর আসামি তার কাছে অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করে। অতঃপর তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য রওনা হলে পথিমধ্যে তার সঙ্গীরা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আক্রমণ করে। গোলাগুলির এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।

অবস্থাটা এমনই যে কোনো আসামি মারা যাওয়ার আগেই তার মৃত্যুর গল্পটা জনগণ পড়ে ফেলে।

মাদক মামলার ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা। প্রথমে গ্রেপ্তার। তারপর অভিযানে মাদক উদ্ধার। বর্তমানে দেশে মাদক সহজলভ্য হওয়ায় শত্রুপক্ষকে ফাঁসানোর একটা সহজ পন্থা হলো মাদক ব্যবসার অভিযোগ। সর্বক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে যে তা সত্যি এ কথা মনে হয় অস্বীকার করা যাবে না। হয়তো সেকারণেই মাদক মামলায় কদাচিৎ শাস্তির খবর পাওয়া যায়।  এক হিসাবমতে গত ২০ বছরে মাদক আইনে দায়েরকৃত ৪৬ হাজার ৯০৭টি নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে ২৩ হাজার ৫৩৫টি মামলার সকল আসামিই খালাস পেয়েছে যার সংখ্যা ২৬ হাজার ১৩৮। (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১)। এই অবস্থাটাও জন মানসে মোকদ্দমা দায়ের থেকে বিচার পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটিকেই অবিশ্বাসের কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেয়।

আরও আছে। কথায় ও কাজে যখন মিল থাকে না এবং এটি যখন বারবার ঘটতে থাকে মানুষ তখন কথাকে আর বিশ্বাস করে না—এমনকি সেটা যদি নিরেট সত্যি কথাও হয়। এই যে দেশে এত কিছু ঘটে গেল—সংখ্যালঘুদের দেবালয় পুড়ল, ঘর পুড়ল, তারপরও থামল না সেই চিরাচরিত বাণীর ঢেউ—এর পেছনে হাত আর ইন্ধন রয়েছে অমুক অমুক দলের। অথচ এখন বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। রংপুরে ধরা পড়েছে সরকারি দলেরই ছাত্র শাখার এক নেতা। কুমিল্লার ঘটনার সঙ্গেও সরকারি দলের কারো কারো সম্পৃক্ততার খবর বেরিয়েছে। আরও উল্লেখ্য, ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনার ক্ষেত্রেই প্রশাসন অকুস্থলে গিয়েছে প্রত্যাশিত সময়ের অনেক পরে। কোন ঘটনা ঘটার অপ্রত্যাশিত বিলম্বের পর যদি প্রশাসন কাজে নামে তাহলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে। এদিকে ইকবাল ধরা পড়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে সেগুলোও মানুষের মাঝে এক ধরনের বিশ্বাসহীনতার ক্ষেত্র তৈরি করছে। যেমন: তার গ্রেপ্তারের পর এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, 'ইকবাল মানসিকভাবে অসুস্থ কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷' এ কথার মানে কী? যে ব্যক্তি অনেক দূরের এক মসজিদ থেকে একটা কোরআন শরীফ বের করে এনে মণ্ডপে রেখে আসতে পারে, এবং পরদিন এ নিয়ে বিক্ষোভে অংশও নিতে পারে—সর্বোপরি ধরা পড়া এড়ানোর জন্য কক্সবাজার চলে যেতে পারে—তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে মানুষের মনে সন্দেহ তো জাগবেই। আর এসবের কারণে সন্দেহ তো জাগতেই পারে—হয়তো বড় কাউকে আড়াল করতেই এই মানসিক রোগাক্রান্ত মানুষটিকে ধরে আনা হয়েছে। এই জাতীয় কথা আর কাজের মধ্য দিয়েই আমরা বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছি।

পাঠক, ছোটবেলায় পড়া মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা নিশ্চয়ই মনে আছে—কেমন করে মিথ্যাবাদী রাখাল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য 'বাঘ বাঘ' বলে চীৎকার করতো। যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ এলো সেদিন কেউ আর তার কথা বিশ্বাস করে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেল না। বিশ্বাসের ভিত ধসে গেলে এমনই হয়। আজকে বাংলাদেশের সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে বিশ্বাসহীনতা বিরাজ করছে—এটি যেকোনো অপমতবাদের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ বিশ্বাস করতে পারাটাও একটা শক্তি। এই শক্তি যদি নিঃশেষ হয়ে যায় তাহলে মানুষ বাঁচতে পারে না। সমাজও এগুতে পারে না। আর যা এগুতে পারে না তা-ই বারবার পেছনের দিকে তাকায়। পেছন শুধু পেছনেই টানে। অথচ সময় এখন এগিয়ে যাওয়ার।

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা, পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, আফগানিস্তান

moshtaque@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

All educational institutions reopen after heatwave-induced closures

After several closures due to the heatwave sweeping the country, all primary and secondary schools, colleges, madrasas, and technical institutions across the country resumed classes today

42m ago