একুশ শতকেও দেশে পেশায় কি ‘জাতপ্রথা’ থাকবে?

'পেশা' নিয়ে তুলকালাম ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। পেশাভিত্তিক বাড়াবাড়ি, বিশেষ পেশার মানুষদের তোষামোদির তেলেসমাতি কাণ্ড, কখনো মিথ্যা পেশার পরিচয়ে বিয়ে করার খবর, সকল সমস্যার মূল কারণ হিসেবে কিছু পেশাকে সনাক্ত করে গালিগালাজ, কারও আবার বিশেষ পছন্দের পেশায় যুক্ত হতে না পারায় মানসিক সমস্যা থেকে শুরু করে শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহই চোখে পড়ে। নির্দিষ্ট কিছু পেশায় যাওয়ার জন্য মা-বাবার চাপ নিতে গিয়েও অনেক সন্তান মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজের চোখে এসব তথাকথিত 'উচ্চবিত্ত পেশা' ছাড়া অন্য সকল পেশাকে অসফল হিসেবে দেখার চর্চা পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতিতে বেশ দাপুটে অবস্থানে আছে। আবার সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আকাঙ্ক্ষিত সমাজের চোখে সফল পেশায় যুক্ত মানুষ, বন্দনার উচ্চ আসীনে স্থান করে নিলেও বিদ্যমান একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সফল পেশার প্রভাব খাটিয়ে জুলুম-নির্যাতন, নিষ্পেষণের মুখোমুখি করার সংবাদও ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়শই উঠে আসে।

পেশাভিত্তিক জাতপ্রথার এমন ধারা আমরা বৈদিক সমাজে দেখতে পাই। একটা সময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে পেশাভিত্তিক বর্ণপ্রথায় ব্রাহ্মণরা নিয়োজিত ছিল শিক্ষা, গবেষণা ও এর অগ্রগতির কাজে। ক্ষত্রিয়রা ছিল সমাজের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে, বৈশ্যরা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে, শূদ্রদের কাজ ছিল সামগ্রিকভাবে সবার সেবায় আরও স্পষ্ট করে বললে বর্তমানে যে কাজগুলো বাঙালি সমাজে মানুষকে ছোট করে, তথাকথিত নিচুজাত পেশায়। অতীতে পেশা হিসেবে চরকা, তাঁত, মৃৎপাত্র তৈরি, পুঁতি তৈরি, সিল তৈরি, পোড়ামাটির ফলক তৈরি, হস্তশিল্প, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রী, কর্মকার, কৃষি ও মৎস্য আহরণ এগুলোই ছিল অন্যতম পেশা। এগুলো থেকে ব্রাহ্মণরা বরাবরই দূরে ছিল।

ভারতীয় আর্যচিন্তায় প্রভাবিত হয়ে কায়িক শ্রম ও কর্মকে ঘৃণা করার মানসিকতার সংস্কৃতির এখনো চলমান। আমাদের মধ্যে জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার, মুচি, মেথর, শ্রমিক, কুলি, মজুর রিকশাচালক ও অন্যান্য অগণিত পেশায় সৎ উপার্জনে নিয়োজিত মানুষদেরকে আমরা আক্ষরিক অর্থে ঘৃণা করি এবং নিচু শ্রেণি বলে বিশ্বাস করি, অসফল, ব্যর্থ বলেও আচরণে, কথাবার্তায় প্রকাশ করি। অপরদিকে অবৈধ ও অনৈতিকভাবে কালোটাকায় বিত্তবৈভবে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া মানুষদেরকে আমরা আন্তরিকভাবে সম্মান করি। অন্তত পেছনে যে যাই বলুক সমাজের চোখে তার সফল মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি মেলে। একজীবনে আরাম, আয়েশ আর সম্মানের মধ্য কাটানো যায় এই প্রবল বিশ্বাস থেকে অভিভাবকরাও তাই সন্তানদের উচ্চবিত্ত হওয়া যায় এমন পেশায় চাকরি দিতে অবৈধ পন্থা অবলম্বন করতে সদাপ্রস্তুত থাকেন। দৈনিক খবরের পাতায় স্থান করে নেওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের লুটপাটের সংবাদগুলো এই দাবিরই সত্যায়ন করে।

দেশে বাহ্যিকভাবে আশরাফ-আতরাফ, ব্রাহ্মণ-শূদ্রের পার্থক্যটা আলোচিত না হলেও এটি প্রকটভাবেই আছে। জাতপ্রথার যন্ত্রণা একুশ শতকে এসেও একই রকম। বাংলাদেশের জাতপ্রথার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হরিজনরা। পুরান ঢাকায় অবস্থানকালে আগাসাদেকখান রোডের মিরনজল্লাতে গিয়ে তাদের খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০১৯ সালে। এখানে প্রায় ১৫ হাজার সুইপারের বসবাস। রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় সারাদেশে হরিজন জনগোষ্ঠীর ১৫ লাখ মানুষের বাস। দেশের 'পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়' ব্রিটিশ আমল থেকে নিযুক্ত এই হরিজনরা এখনো জাতপ্রথায় নিষ্পেষিত। মিরনজল্লা কলোনিতে থাকা রুবেল আমাকে জানিয়েছিল সে শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় অনার্স ও কবি নজরুল কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করলেও জাতপ্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাননি। চাকরি খুঁজতে গিয়ে যখনই সনদপত্র ও জীবনবৃত্তান্ত দেখে চাকরিদাতারা দেখেছে সে হরিজন সম্প্রদায়ভুক্ত তখন তাকে চাকরিতে নিতে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। রুবেল সে সময় আমাকে জানিয়েছিল, এই মিরনজল্লাতেই অনেক যুবক আছে কেউ আর্কিটেকচার, কেউ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি বিষয়ে ডিপ্লোমা/স্নাতক, শেষ করা। কিন্তু যখনই কোনো প্রতিষ্ঠান জানতে পারে এরা সুইপার কলোনি থেকে বেড়ে ওঠা তখন কেউই আর তাদেরকে চাকরিতে নিতে আগ্রহ দেখায় না।

অথচ মানুষ পেশা সৃষ্টি করেছে মানুষের প্রয়োজনে, পেশা মানুষ তৈরি করেনি। ইতিহাস বলে জাতপ্রথার রক্ষণশীল সময়েও বিভিন্ন নিচুপেশায় থেকেও অনেকেই হয়েছে স্মরণীয়। সেই রক্ষণশীল সমাজেও জ্ঞানী পণ্ডিত ঋগ্বেদের কবি হিসেবে পরিচিত, একজন পতিতা উর্বশীর ছেলে ভাসিসতা ভারতের পুরো ব্রাহ্মণ সমাজে সম্মানিত হয়ে আছেন, ক্ষত্রিয় বিশ্বমিত্র যিনি গায়ত্রী মন্ত্র তৈরি করেছেন যা বৈদিক ঋগ্বেদের এর একটি সূক্ত, তা এখনো হিন্দুদের বাড়িতে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভারত জুড়ে প্রতিদিন আবৃত্তি করা হয়, ঋগ্বেদের সংস্কারমূলক গ্রন্থ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ নামে এই 'ঐতরেয়' মূলত একজন ব্রাহ্মণের অনার্য স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান। মহাভারতের রচয়িতা ব্যাস একজন মৎস্যজীবী নারীর সন্তান। রামায়ণের মূল লেখক বাল্মীকিও একজন অস্পৃশ্য পরিবারের সন্তান। জাতপ্রথার এই যাতাকলে থেকেও তারা ভারতে অনেক বেশি সমাদৃত।

ইসলামের ইতিহাসেও দেখি আদম (আ.) ছিলেন কৃষক, ইদ্রিস (আ.) ছিলেন দর্জি, নূহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন রাজমিস্ত্রি, ইলিয়াস (আ.) ছিলেন তাঁতি, দাউদ (আ.) ছিলেন কামার, মুসা (আ.) ছিলেন রাখাল, ঈসা (আ.) ছিলেন ডাক্তার, মুহাম্মাদ (সা.) বাল্যবেলায় রাখাল ছিলেন, পরবর্তী জীবনে ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, পেশায় নিয়োজিত থেকে কাজের গুণে, সেবার মানসিকতায়, মানবতার সমস্যা-সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রেখে অমর হয়ে আছেন।

বিপরীতে যদি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের হাল আমলের অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর জরিপের তথ্য বলছে দেশের শিক্ষিত যুবকদের দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। এই বেকারের বড় কারণ তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়ার অপেক্ষা ও দিনশেষে সেই চাকরি না পাওয়া। এর অন্তর্নিহিত কারণ লোকসমাজে, পরিবার, পরিজন, বন্ধু-সমাজে যেন হিরো কিংবা হিরোইন বেশে সম্মানজনকভাবে জীবনকে যাপন করা যায়। যার গহীনে লুকিয়ে আছে কাজের মধ্যে জাতপ্রথা খুঁজে বের করে উচ্চ জাতপ্রথায় লীন হয়ে যাওয়ার ব্যাকুল বাসনা। এই ব্যাকুল বাসনায় আমাদের শিক্ষিত বেকারের বড় একটি অংশ বিভোর। যারা শারীরিক তথা কায়িক পরিশ্রমে লজ্জাবোধ করেন, নিজের মানসম্মানের, বংশগৌরবের প্রবল হানি ঘটবে বলে বিশ্বাস করেন, সেই সঙ্গে মানসিক পরিশ্রমেও পিছিয়ে, তাদের প্রযুক্তির জ্ঞানও শূন্যের কোঠায়, তাই সবকিছুর যোগফলে দিন শেষে মনের ভেতরে লুকায়িত এই জাতপ্রথাই আমাদের শিক্ষিত সমাজ ও শিক্ষার্থীসমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

ইতিহাস ও বাস্তব জীবনের জ্ঞান আমাদেরকে শেখায় প্রত্যেক পেশায় নিয়োজিত মানুষকেই অপর পেশায় মানুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। পরস্পরকে সহযোগিতা, সহমর্মিতা দেখাতে হয়। একটি নির্দিষ্ট পেশায় নিযুক্ত থাকা মানুষ সমাজের জন্য, নিজের জন্য যথেষ্ট না, সক্ষমও নন, সকলের চাহিদা পূরণ তো দূরের কথা, নিজের চাহিদাই তার পূরণ করতে তাকে সকলের প্রয়োজন। সেটি যখন ভুলে যাই আমরা তখন নির্দিষ্ট পেশায় যুক্ত থেকে একটু বেশি ভালো থাকতে গিয়ে একজন সরকারি আমলা, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক তার পরিবারকে সচ্ছল ও ভালো রাখতে ফি বাড়িয়ে দেন, কেউবা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুষ নেন। এভাবে প্রত্যেকের ঘুষ, কিংবা ফি যখন বেড়ে যায় তখন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কিংবা যেকোনো সেবাখাত থেকে সেবা নিতে অনেক বেশি ব্যয় বেড়ে যায় প্রতিটি মানুষের। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন গরিব মানুষ। তারা স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা সেবা, আইন, অধিকারের সেবা থেকে বঞ্চিত হন। ডাক্তার ফি বাড়ানোয়, আইনজীবী ফি বাড়ান, তার ফি বাড়ার কারণে স্কুল শিক্ষক ফি বাড়ান, এভাবে একে একে বেড়ে যায় আমাদের ট্যাক্স, এভাবে ধনী ও গরিবের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয়। একটা সময় তা সমাজে বিশৃঙ্খলা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, চুরি, রাহাজানি অরাজকতার পথ তৈরি করে দেয়। যা ধীরে ধীরে একটা রাষ্ট্রের পতন তরান্বিত করে। বর্তমান বাংলাদেশকে দেখলে এর হুবহু মিল পাওয়া যায়। মানুষের কাজের মধ্য দিয়েই পেশা মহান হয়ে ওঠে, কোনো পেশাই মানুষকে মহান করে চিরায়ত রাখতে পারে না। তাই ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে ঋণ, সাহায্য, ত্রাণ, শ্রমহীন কর্ম থাকা, পরনির্ভর থাকা, অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী থাকার আশা বাদ দিয়ে শারীরিক, মানসিক শ্রমের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার গুরুত্ব যত দ্রুত আমরা বুঝতে পারব ততই বেকারত্ব দূরীকরণ ও পেশাভিত্তিক সেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

মুতাসিম বিল্লাহ: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

mutasim.b@cou.ac.bd 

Comments

The Daily Star  | English

$14b lost to capital flight a year during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

9h ago