ঈদে কী সাম্য আসে!

এতো লোক চলে গেছে, তবু রাজধানীতে যে লোকের অভাব নেই তার অর্থ ওই যে টেনে নেওয়া এবং ঠেলে বের করে দেওয়া এই ব্যাপারটা, পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই শহরে এখন থাকার জায়গার তো অভাবই, চলেফেরা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ পজিশনে থাকার।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

এতো লোক চলে গেছে, তবু রাজধানীতে যে লোকের অভাব নেই তার অর্থ ওই যে টেনে নেওয়া এবং ঠেলে বের করে দেওয়া এই ব্যাপারটা, পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই শহরে এখন থাকার জায়গার তো অভাবই, চলেফেরা করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন তাদেরকে হুকুম করা হয়েছে স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ পজিশনে থাকার।

বিদেশে বসবাসকারী এক তরুণের একটি কবিতা পড়লাম সেদিন। যানবাহনের অবস্থা দেখে তার মনে হয়েছে যে অসংখ্য নৌকা শহরে চলে এসেছে। কিন্তু নৌকার যা আছে গাড়ির তা নেই। যতো ধীর গতিতেই হোক নৌকা চলে। সামনে এগিয়ে যায়, কিন্তু এই গাড়িগুলোর কোনো গতি নেই, তারা স্তব্ধ। কথাটা খুবই সত্য। গ্রামে নদী নেই, নৌকা তাই চলে এসেছে শহরে। কিন্তু রাজপথে নৌকা চলবে কী করে? সেখানে তো পানির অভাব। অনেক সময় মনে হয়, হেঁটে বরঞ্চ দ্রুত যাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা ভ্রমমাত্র। স্বচ্ছন্দে, নির্বিঘ্নে হাঁটা যাবে এমন ফুটপাত মস্ত এই ঢাকা শহরে একটিও অবশিষ্ট নেই। উন্নতি তাদেরকে গিলে খেয়েছে।

আমাদের দরকার সামাজিক যানবাহনের। চাই একতলা, দোতলা বাস। দরকার পাতাল রেল। প্রয়োজন নৌপথে যাতায়াতের বন্দোবস্ত। কিন্তু উন্নতির যে ভয়াবহ খপ্পরে আমরা পড়েছি তার পক্ষে সামাজিক যানবাহনের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়াটা যে কত কঠিন, ঢাকার রাজপথে তো প্রতি মুহূর্তেই তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রাইভেট গাড়িগুলো চলছে না, পাবলিক বাসের জন্য শত শত পাবলিক লাইন ধরে প্রতীক্ষা করছে—এই দৃশ্য কার কাছে অপরিচিত? আমাদের উন্নতি প্রাইভেটে বিশ্বাস করে, পাবলিককে পারলে পিষে মেরে ফেলে, নুইসেন্স বিবেচনা করে। যে জন্য চিকিৎসা মানেই এখন প্রাইভেট হাসপাতালে ছোটা। সরকারি হাসপাতালে তারাই যায়, যারা আমাদের ওই ফেরিওয়ালা বন্ধুটির দলে।

ঈদকে বলা হয় সাম্যের উৎসব। ধনী-দরিদ্র এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু তাদের খবর কী যারা বড় বড় মসজিদের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকে ধনীদের অনুকম্পার আশায়। খুব এটা যে পায় তা নয়, তবু আসে, আশায় আশায় থাকে। অনেকে প্রাইভেট কারে করে ঈদের জামাতে আসে, গাড়ির ড্রাইভারও সামিল হয়, কিন্তু ওইটুকু পর্যন্তই। জামাত শেষ হওয়ামাত্র ড্রাইভার চলে যায় তার জায়গাতে, মালিক গিয়ে বসে নিজের আসনে।

জামাতে ইমাম সাহেব বলেন, ঈদ হচ্ছে একতার উৎসব। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন। মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে সেই বাণী। কিন্তু বাইরে আসামাত্র দিবালোকের মতো যে সত্যের মুখোমুখি হতে হয় সেটা হলো অনৈক্য নয়, বিচ্ছিন্নতা।

ঈদ এখন যে সত্যটিকে উন্মোচিত করে দেয় সেটা হলো, সমাজে বিদ্যমান অসাম্য। ব্যাপারটা এমন স্পষ্ট করে কম সময়েই এসে আমাদেরকে ধাক্কা দেয়। মধ্যবিত্তের একাংশ ও নিম্নমধ্যবিত্তের বৃহদাংশ দেশের বাড়িতে ছোটে আপনজনের সান্নিধ্য পাবে বলে। গরিব মানুষ কী করবে ভেবে পায় না, নিতান্তই অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে তাদের চালচলনের দিকে। ঈদ আসলে বিত্তবানদেরই। কিন্তু তারাও ঈদে সামাজিক থাকে না, বিচ্ছিন্নই রয়ে যায়। ঈদের অনেক আগে থেকেই, এমনকি রোজার শুরু থেকেই তারা বিপণিবিতানে ছোটাছুটি শুরু করে উপযুক্ত সাজসজ্জার সন্ধানে। সবাই সবাইকে দেখাতে চায়, কিন্তু আদতে কেউ কারোটা দেখে না।

এই ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেক এগিয়ে থাকে পুরুষদের তুলনায়। মনে হয়, কেবল মনে হয় না, ঘটনাও আসলে তাই, ঈদ পুরোপুরি করতলগত হয়ে গেছে বাণিজ্যের। ফ্যাশনের বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন শোর উদ্বোধন, ঈদ ফ্যাশন নিয়ে পত্রিকার বিশেষ আয়োজন—সবকিছুই একটা কথা বলে, সেটা হলো ঈদে বাণিজ্যই প্রধান। নামীদামী লোকেরা প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন, বিহ্বল দৃষ্টিতে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ডিজাইনের সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকেন। বিনোদন জগতের দিকপালেরা মডেল হতে দ্বিধা করেন না।

ওদিকে চলে খাদ্যের আয়োজন। রোজার মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে থাকে। বাড়বেই। কেননা ধনীরা এই মাসটিকে ভোজনের উৎসবে পরিণত করে ফেলে। ঈদের জন্য বিশেষ ধরনের খাদ্র্য প্রস্তুত প্রণালীর প্রদর্শনী চলতে থাকে টেলিভিশনে ও পত্রিকায়। বিশেষজ্ঞরা এসে হাজির হন। দশ বছর আগে একজন তথ্যাবিজ্ঞের কাছে শুনেছিলাম যে, এই শহরে যেকোনো নতুন খাদ্যই বাজারজাত করা হোক না কেন তার জন্য এক লাখ ভোক্তা প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যাবে। এতদিনে মনে হয় ওই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

অন্য অনেক কিছুর মতোই ঈদও এখন আর সামাজিক নেই, ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও ঈদকার্ডের পারস্পরিক বিনিময়ের একটা প্রথা ছিল। ওইসব কার্ড দোকানে পাওয়া যেতো। এখন লোক দোকানে গিয়ে কার্ড কেনার এবং পোস্ট অফিসে গিয়ে তা পোস্ট করার চেয়ে এসএমএস-এ একান্ত ব্যক্তিগত বাণী প্রেরণ পছন্দ করে। তাই বলে কার্ড প্রেরণ যে উঠে গেছে তা নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের অর্থে ব্যক্তিগত কার্ড পাঠিয়ে থাকেন। প্রত্যেকের কার্ড স্বতন্ত্র, কোনোটাই দোকানের নয়, সবগুলোই প্রদানকারীর পছন্দ অনুযায়ী প্রস্তুত।

ভালো কথা, ঈদের ছুটিতে ধনীরা মফস্বলে যায় না এটা ঠিক, তবে পুরাতন এই শহরে যে থাকতে পছন্দ করে তাও নয়। কেউ যায় সমুদ্র সৈকতে, কেউ খোঁজে রিভার রিসোর্ট, আরও যারা বিত্তবান তারা চলে যায় বিদেশে।

কিন্তু আমরা যারা এসব কথা বলছি তারা কী চাই? আকাঙ্ক্ষাটা কী? না, আমরা বড় কিছু চাই না, চাই সামাজিকীকরণ। যেমন যানবাহনের তেমনি ঈদের মতো উৎসবেরও। আমরা চাই গ্রাম যেন মানুষকে আশ্রয়স্থল থেকে উৎপাটিত করে শহরের দিকে ঠেলে না দেয়। তার জন্য প্রয়োজন হবে কর্মসংস্থানের, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের। ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলা দরকার। নদী ও জলাশয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার চাই। চাই ফসলী বৃক্ষেও সাহায্যে সামাজিক বনায়ন। চাইবো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি, যাতে গ্রামে থাকাটা বিপজ্জনক বলে ধারণা না হয়। দরকার মফস্বলে উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। চিকিৎসার উন্নয়নের জন্য আয়োজন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের। আমরা চাইবো গ্রামকে শহরের দিকে টেনে না এনে শহর নিজেই গ্রামের দিকে রওনা দিক।

এসব কাজ মোটেই ছোট নয়। অত্যন্ত বড় ও কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, যে বিকেন্দ্রীকরণ গণতন্ত্রের প্রধান শর্তগুলোর একটি। উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু উপজেলা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। কারণ ক্ষমতা কার কাছে কতটা থাকবে ঠিক করা যায়নি। ক্ষমতা তো যাবে সাধারণ মানুষের কাছে, তা যাচ্ছে না। সংসদ সদস্যরা বিকেন্দ্রীকরণে সাহায্য করবেন কী, উল্টোটা ঘটাচ্ছেন। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে বলে শুনেছি, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যা টের পাচ্ছি তা হলো, সমস্ত ক্ষমতা চলে গেছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

অপরদিকে বিরোধী দলেও নেত্রীই সর্বেসর্বা, অন্যরা তার মুখাপেক্ষী ভিন্ন অন্যকিছু নয়। সুযোগ্য তত্ত্বাবধায়কেরা রাজনীতিতে কোন ধরনের সংস্কার আনতে চেয়েছিল সেটা তার ও তাদের জানা-অজানা মুরুব্বীরাই জানে, কিন্তু দেশবাসী যে সংস্কার লাভ করেছে তা হলো ক্ষমতার অধিকতর কেন্দ্রীভবন।

বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের শাসনকর্তা যে শাসক শ্রেণি তারা তো কিছুতেই চাইবে না যে, ক্ষমতা তাদের হাত থেকে জনগণের হাত চলে যাক। তাদের চেষ্টা ক্ষমতা যেখানে থাকার সেখানেই থাকবে। ফেরিওয়ালা তার সম্পত্তি মাথায় করে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, সম্পত্তিবানরা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে চিন্তা দিয়ে মাথাভর্তি করে রাখবে। কিন্তু যে দেশে কয়েক কোটি মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই, সে দেশকে কোন অর্থে স্বাধীন বলা যাবে সে প্রশ্নটা তো থাকবেই।

আমরা তার মুখোমুখি হলে দায়িত্ব বাড়ে। আর সে দায়িত্বটা অন্য কিছুর নয়, আমাদের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বটে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, সহজে শেষ হওয়ারও নয়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

 

Comments