আহারে! হতভাগ্যরা উন্নয়ন দেখে যেতে পারল না
সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লেগে এখন পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা প্রায় দুই শ। এখনও অনেক ব্যক্তি নিখোঁজ আছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আশেপাশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কখন আগুন নেভানো যাবে তা এখনও অনিশ্চিত। সবার আশঙ্কা, ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
খবরে প্রকাশ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন ডিপো পরিচালনায় বিরাট অবহেলা রয়েছে। এই অবহেলার চিত্রটি বোঝা দরকার।
প্রথমত, কন্টেইনার ডিপোতে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড নামক রাসায়নিক পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই রাসায়নিক যৌগটি উত্তপ্ত অবস্থায় বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে। আগুন নির্বাপণকারীরাও জানিয়েছেন এই রাসায়নিকের কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং এত প্রাণহানি ঘটছে। প্রশ্ন হলো একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে এত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক কীভাবে এলো? চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলেছে তাদেরকে এই বিষয়ে জানানো হয়নি এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুদের জন্য কোনো লাইসেন্সও নেওয়া হয়নি। কিন্তু বিস্ফোরক পরিদপ্তরই বা কী করছিল? এই ধরনের ডিপোগুলোতে কোন ধরণের মালামাল আনা-নেওয়া ও মজুদ করা হয় এবং সেসব উপকরণ হ্যান্ডেল করার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও জনবল আছে কি না তা দেখার কি কেউ নেই?
দ্বিতীয়ত, সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম প্রশ্ন তুলেছেন এই রকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিকের ডিপো করা হয়। এই প্রশ্নটি আমাদেরও। এই ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাটি জনবসতির এতই কাছাকাছি যে এর বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক বাড়ির ঢেউটিন উড়ে গেছে, দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। এই প্রকল্পের অনুমোদন কে দিলো?
তৃতীয়ত, মালিকপক্ষ না আসায় ডিপোতে কী ধরনের রাসায়নিক উপকরণ আছে রোববার বিকেল পর্যন্ত তা জানা যায়নি। ফলে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদেরও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে এবং পুরো উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই মালিক পক্ষ কারা? সরকার কি এতই দুর্বল যে যেকেউ এরকম ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে গায়েব হয়ে যেতে পারে?
বিএম কন্টেইনার ডিপোর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের জয়েন্ট ভেঞ্চার এই কোম্পানিটি ২০১১ সাল থেকে কাজ করছে। ফলে গত ১১ বছর ধরে সরকারের চোখের সামনেই এই মৃত্যুকূপটি গড়ে উঠেছে। বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের অপরাধের তো বিচার করতেই হবে কিন্তু সরকারি দায়িত্বে অবহেলার জবাবদিহিতা করবে কে?
মনে রাখতে হবে সীতাকুণ্ডের ঘটনা সীতাকুণ্ডেই শেষ নয়। কন্টেইনার ডিপো মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কাইয়ূম বলেছেন কম্বোডিয়াগামী হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বহনকারী কন্টেইনার থেকেই আগুনের সূত্রপাত। একবার ভাবুন এই কন্টেইনারটি যদি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর দুর্ঘটনাটি ঘটত তাহলে কী হতো? আমরা কি বৈরুত বন্দর বিস্ফোরণের মতো একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতাম?
অনেকেই বলবেন, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এই রকম ঘটত না। তাহলে সরকার কী বলছে শুনুন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর কাছে জানতে চান বন্দরে যেসব পণ্য আসছে তার মধ্যে বিপজ্জনক কোনো পণ্য আসছে কি না এবং পণ্য স্ক্যান করা হয় কি না । উত্তরে তিনি বলেন, 'এর আগে তো কোনো স্ক্যানারই ছিল না। সাধারণত ঘোষণাপত্রের মধ্যে দিয়ে এগুলো আনা-নেওয়া হতো। ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করে আমাদের হ্যান্ডলিং করতে হতো। এখন স্ক্যানার বসানো হয়েছে, আরও স্ক্যানার বসানো প্রক্রিয়াধীন। এখন কিছুটা হলেও স্ক্যানিং হচ্ছে।'
তাই কাঠামোগত দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনার পুরো চিত্রটি আমলে না নিলে সমস্যার গভীরতা টের পাওয়া যাবে না।
সীতাকুণ্ডের আগুন না নিভতেই সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে ফেলেছে। তবে অতীতের উদাহরণ দেখলে মনে হয় অন্যান্য তদন্ত কমিটির মতো এটিও কয়েকদিন খুব তোড়জোড় চালাবে, সরেজমিন পরিদর্শন হবে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আশ্বাসের ফুলঝুরি উঠবে, সমস্যা সমাধানে আশু ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হবে, দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে ঘোষণা দেওয়া হবে, তারপর আবার সব চুপ। উন্নয়নে ডামাডোলে আবার সব হাহাকার চাপা পড়ে যাবে।
এই প্রহসনের একটি নমুনা দেই। গত ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্তি হলো। ২০১০ সালের এই দিন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক কারখানার গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা ১৭টি সুপারিশ প্রদান করেন। পুরান ঢাকা থেকে যত দ্রুত সম্ভব সব রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে ফেলা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু গত এক যুগে কোনো অঙ্গীকারই বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি মর্মান্তিক সেই ঘটনায় কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। কেবলমাত্র বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। সেই সাধারণ ডায়েরির তদন্তকাজ কি অবস্থায় আছে তা বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা কিছুই জানেন না।
নিমতলীর পথ বেয়ে ২০১৯ সালে যখন চকবাজারে আগুন লেগে ৭০ জন মারা গেল তখন আবারও একই আশ্বাস দেওয়া হলো। তারপর আবার সবাই চুপ। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় এই প্রহসনের পুনরাবৃত্তি হলে তাই অবাক হব না।
নিমতলী, চকবাজার, সেজান জুস কারখানাসহ আরও অনেক ছোট বড় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হবে সীতাকুণ্ডে নিহত সাধারণ মানুষের নাম। কিন্তু উন্নয়ন চলবেই। আহারে এই হতভাগ্যরা এত উন্নয়ন দেখে যেতে পারল না।
সামসুদ্দোজা সাজেন: সাংবাদিক ও গবেষক
sajen1986@gmail.com
Comments