আর কত দুর্ভোগ, কবে বসবে বিমানবন্দরে আরটি-পিসিআর মেশিন
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য ল্যাব বসানোর দাবিতে রাজধানীর প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সামনে আজ মঙ্গলবার প্রতিবাদ করেছেন প্রবাসীরা। তারা বলছেন, এই পরীক্ষার সুবিধা না থাকায় আরব আমিরাত ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ফের ফ্লাইট চালুর কথা হলেও পিসিআর বসেনি। ফলে অনিশ্চয়তায় আছেন তারা।
এর আগে, ৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রীপরিষদ সভা শেষে জানানো হয়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এয়ারপোর্টে করোনাভাইরাসের পিসিআর পরীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৮ দিন পেরিয়ে গেলেও সেটি এখনও চালু হয়নি। অথচ সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
বৈঠক শেষে সেদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ থেকে এখন যাত্রার ৭২ বা ৪৮ ঘণ্টা আগে পিসিআর পরীক্ষা করে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ সম্প্রতি উড্ডয়নের ৬ ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের সনদ চেয়েছে। আজকে এটা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, ভেরি কুইকলি দুই বা তিন দিনের মধ্যে এয়ারপোর্টেই একটা টেস্টিং ফ্যাসিলিটিজ করা হবে। অন্যান্য দেশেও যেরকম আছে। যাতে ফ্লাই করার আগের চার ঘণ্টার মধ্যে উনারা টেস্ট করতে পারেন।'
সেদিনের বৈঠকের পর জানানো হয়, শুধু ঢাকা নয়, বিদেশগামীদের সুবিধার্থে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দ্রুত করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর ল্যাবের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ৮ দিন হয়ে গেলেও এখনও সেটি চালু করা যায়নি। শুধু এবার নয়, মহামারির এই দেড় বছরে উড়োজাহাজের টিকিট থেকে শুরু করে টিকাসহ প্রবাসীর যত বিষয় আছে সবক্ষেত্রেই সমন্বয়হীনতার ছবি উঠে এসেছে। পিসিআর মেশিন বসানোয় বিলম্ব তাতে সর্বশেষ সংযোজন।
করোনাভাইরাস শনাক্তে এখন পর্যন্ত বিশ্বে কয়েকটি নমুনা পরীক্ষা পদ্ধতি থাকলেও আরটি-পিসিআরই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক খবর বলছে, সরকারিভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিমানবন্দরে পিসিআর বসানোর দায়িত্ব না নিলে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই কাজ পেতে তোড়জোড় শুরু করে ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্য অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হওয়ায় ল্যাব স্থাপনের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ডিএমএফআর'র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ। পরে তিনি তার শেয়ার বিক্রি করে দেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফাইজুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটি ২৯ আগস্ট প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ল্যাব স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করে।
৩১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সুপারিশ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেয় ঢাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাস। দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষরবিহীন সেই চিঠিতে বলা হয়, আরব আমিরাতের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত লাইফডিএক্স নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ আছে ডিএমএফআর'র। এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির আবেদনেও নানা অসঙ্গতি পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, শুরুতে করোনা পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৭০০ টাকা রাখার প্রস্তাব করে আবেদন করলেও, কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে আরও এক হাজার টাকা বাড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। আবার আরও ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান ২ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে টেস্ট-ফি নির্ধারণ করে আবেদন করলেও সেগুলোকে মূল্যায়ন করা হয়নি।
মাঝে মধ্যে আসলেই অবাক লাগে। বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষার দাবি দীর্ঘদিনের। পাশের দেশ ভারত শুধু দিল্লি নয়, কলকাতার বিমানবন্দরেও এই ব্যবস্থা চালু করেছে। আর বাংলাদেশে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের আগপর্যন্ত নীতি-নির্ধারকদের মাথাতেই আসেনি যে বিমানবন্দরে পিসিআর বসানো দরকার। এরপর যখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদ সিদ্ধান্ত নিলো, এখন সেটির বাস্তবায়নেও শুরু হয়েছে জটিলতা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, পিসিআর ল্যাব স্থাপনের জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। সরকার যাকে এগুলো বসানোর কাজ দেবে, তারা শুধু এখানে স্থাপন করবে। কিন্তু কবে নাগাদ বসবে সে বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু জানে না। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে বসে আছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওপর। এসব সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছেন প্রবাসীরা।
এক কোটিরও বেশি প্রবাসী এখন বিদেশে আছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রায় ৩ মাস বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞার পর গত ৪ আগস্ট বাংলাদেশসহ ৬ দেশের যাত্রীদের ট্রানজিট সুবিধা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। শর্ত দেওয়া হয়, ফ্লাইট ছাড়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট থাকতে হবে। আমিরাতের এই শর্ত মেনে ইতোমধ্যে পাকিস্তান, ভারতের কর্মীরা কাজে ফেরা শুরু করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও পিসিআর মেশিনই বসাতে পারেনি।
এসব কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে প্রবাসীরা অনশনে বসেছেন। এর আগে, দেশে আটকেপড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীরা সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান আহমেদ রিয়াজ বলেন, 'সোমবার থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পতাকাবাহী বিমান পরিবহন সংস্থা এমিরেটস এয়ার ও আবুধাবির ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে ফের ফ্লাইট পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু পিসিআর ল্যাব না থাকায় আবারও বাংলাদেশে ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে পারে এই দুই এয়ারলাইন্স। এর ফলে দেশে আটকেপড়া ৪০ থেকে ৫০ হাজার প্রবাসী উৎকণ্ঠায় আছেন।
দুবাই আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক সাজ্জাদুল ইসলাম শফি আজ সকালে একটি মেসেজ পাঠিয়ে আফসোস করে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও আজ এক সপ্তাহের বেশি হলো এখনও এয়ারপোর্টে পিসিআর মেশিন বসানো গেল না। দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙবে কখন? উগান্ডা, নাইজেরিয়া তাদের এয়ারপোর্টে পিসিআর মেশিন বসাতে পারলেও, আমরা পারছি না কেন?'
সাজ্জাদুল বলেন, 'অক্টোবর থেকে এক্সপো শুরু দুবাইতে। অনেক কষ্ট করে একটা কোম্পানি করেছি। এক্সপোতে কাজ পেয়েছি ইন্ডিয়ান প্যাভিলিয়নে। আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী এই এক্সপোর অপেক্ষায় আছেন। আমার নিজের কোম্পানির ৬ জন কর্মী ছুটিতে গিয়ে আটকা পড়েছেন। দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙবে কখন?'
এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আসলে দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙবে কখন?
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
shariful06du@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments