অধিকারের দাবিতে জেগে উঠুক গ্রামীণ নারী
১৬০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রায় ১০৭ মিলিয়ন মানুষের বসবাস গ্রামীণ এলাকায়। এর মধ্যে অন্তত ৫০ মিলিয়ন নারী ও শিশু। যারা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। গবেষণা অনুসারে, পরিবারের কল্যাণের জন্য তারা অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে চলে। প্রায়শ দিনে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করে। এরপরেও তারা অদৃশ্য ও অবমূল্যায়িত থাকে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা তাদের দেওয়া হয় না।
প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং পরিবার ও সমাজের দারিদ্র্য নিরসনে নারীদের অবদানের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ২০০৮ সালে জাতিসংঘ প্রথমবার দিবসটি পালন করেছিল।
বৈশ্বিক পর্যায়ে সাব-সাহারা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মৌলিক খাদ্য উৎপাদন করে। গোটা এশিয়ায় ধান চাষে তাদের ৫০ শতাংশের বেশি শ্রম রয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর গ্রামীণ নারীরা ৩০ শতাংশ কৃষিকাজ সম্পাদন করে। একক মা (সিঙ্গেল মাদার) হিসেবে গৃহস্থালীর ৬০ শতাংশ কাজ তারাই করে। এ ছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে ৯০ শতাংশ পানি ও জ্বালানির চাহিদা মেটায় তারা। এরপরেও বিশ্বের ৫০০ মিলিয়ন গ্রামীণ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।
এ বছর গ্রামীণ নারীদের উঠে আসার ও টেকসই উন্নয়নে তাদের অধিকার দাবি করার আহ্বান জানানো হয়েছে। যা একইসঙ্গে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয়। এটা ভালোভাবেই স্বীকৃত যে, নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা যাবে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জরুরি প্রেক্ষাপটে এই আহ্বান প্রাসঙ্গিক। এটি গ্রামীণ নারীদের তাদের নিজ নিজ জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে, পরিবার ও সমাজে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এর জন্য সমাজ ও পরিবারকে অবশ্যই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেইসঙ্গে তাদের এই স্বীকৃতি দিতে হবে যে, তারা জাতি নির্মাতা। যে কারণে তাদের মূল্যায়ন ও সম্মান করা উচিত।
এটা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের সব শ্রেণির নারীরা নিপীড়ন ও অবহেলার শিকার। তারপরেও গ্রামাঞ্চলের নারী ও মেয়েশিশুরা বেশিমাত্রায় দারিদ্র্য এবং নেতিবাচক সামাজিক আচার ও চর্চার শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া পারিবারিকভাবেও বৈষম্যের শিকার হওয়ার পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায়নের অভাব আছে। গবেষণায় দেখা যায়, দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে দারিদ্র্যের হার শহর এলাকার তুলনায় বেশি। যার অসম প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ নারীদের ওপর।
বাংলাদেশে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীর মতোই উৎপাদনশীল ও উদ্যোগী হতে পারে। কিন্তু ভূমি, ঋণব্যবস্থা, কৃষি উপকরণ কিংবা বাজার- কোনোখানেই তাদের সমান প্রবেশাধিকার নেই। কৃষিতে বেশিরভাগ নারীর অবদান অদৃশ্য থাকে। যা 'সংসারের কাজ' হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আমাদের আইন, নীতি ও সামাজিক চর্চা সম্পত্তিতে নারীর মালিকানার বিষয়টি সমর্থন করে না। গ্রামীণ নারী ও মেয়েশিশুদের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তারা তাদের পড়াশোনা শেষ করতে পারে না। চাকরিতে সুযোগ থাকে খুবই কম। আর তারা সামাজিক রীতি মানতে বাধ্য থাকে। যা তাদের প্রথাগত গৃহস্থালির কাজ ও পরিবারের যত্ন নেওয়ার নির্ধারিত ভূমিকায় যুক্ত করে।
চলমান কোভিড-১৯ মহামারি লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস করে দিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে সামাজিক কাঠামো। বাংলাদেশের নারী ও শিশুরাও এই মহামারির শিকার। স্বাস্থ্য ও পারিবারিক সংকটের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম। নারীদের দায়িত্বের দ্বিগুণ বোঝা বেড়ে বহুগুণ হয়েছে। অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় গ্রামীণ নারীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই পুরুষ সঙ্গীদের মতো তাদেরও প্রণোদনা, সহযোগিতা ও আর্থিক সহায়তা দরকার।
কাঠামোগত বাধা ও নেতিবাচক সামাজিক রীতি নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও অংশগ্রহণকে সীমাবদ্ধ করে চলেছে। বেশিরভাগ পরিবারে বৈষম্যমূলক চর্চার কারণে গ্রামীণ এলাকার নারী ও মেয়েশিশুদের উৎপাদনশীল সম্পদ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো খাত এবং পানি ও স্যানিটেশনের মতো অবকাঠামোগত বিষয়গুলোতে সমান প্রবেশাধিকারের ঘাটতি আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বব্যাপী জেন্ডার ও উন্নয়নসূচকগুলোতে দেখা যায়, গ্রামীণ নারীদের অবস্থা গ্রামীণ পুরুষ কিংবা শহুরে নারীদের চেয়ে খারাপ। তার ওপর দারিদ্রতা, বিচ্ছিন্নতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হয় অসম।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সুতরাং বলা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের অবদানও বেড়েছে। কৃষির মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা বিভিন্ন উপার্জনমূলক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যার মধ্যে আছে ফসল বোনার আগে-পরের নানা কর্মকাণ্ড। যেমন- বীজ বাছাই, ফসল মাড়াই, সংরক্ষণ, ইত্যাদি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ধানক্ষেতে নারীদের কাজের বিষয়টি একটা নিয়মিত দৃশ্য। অনুমান করা হয়, গ্রামীণ নারীরা গৃহস্থালীর আয়ে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ অবদান রাখেন। যার ৪৮ শতাংশ কৃষিকাজ সংক্রান্ত। এর পরেও বাংলাদেশের কৃষিখাতে নারীরা অদৃশ্য। এই ধারণার জন্য যে, তারা কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক শ্রম দিতে অক্ষম।
গ্রামীণ নারীরা তাদের পরিবারের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। গৃহস্থালীর সবজি বাগান, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন- সবই তাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বজায় রাখতে অবদান রাখে। কিছু রান্না করা খাবার রাখার জন্য তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করেন। পরিবারের সবার খাওয়া নিশ্চিত করতে তারা সাধারণত সবার শেষে খান। গ্রামের একটা পরিবার যতই দরিদ্র হোক না কেন, দিনে তারা অন্তত দুই বার খাবার খায়। স্যার ফজলে হাসান আবেদের একটা বিখ্যাত উক্তি এ রকম, 'বাংলাদেশের নারীরা বিশ্বের সেরা ব্যবস্থাপক। কারণ তারা দারিদ্র্য সামলাতে পারে।' এই উক্তির কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই। আর সে কারণেই স্যার আবেদ ব্র্যাকের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের এর সুবিধাভোগী হিসেবে টার্গেট করেছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলার ক্ষেত্রেও গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা কম নয়। বিশেষ করে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স তৈরির ক্ষেত্রে। সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, গ্রামীণ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও প্রতিবেশগতভাবে টেকসই পরিবেশব্যবস্থা গড়তে পরিবেশের ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে গ্রামীণ নারীর ভূমিকা একটি এন্ট্রি পয়েন্ট হতে পারে।
সুতরাং, গ্রামীণ নারীদের এখন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। দেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে ও দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় শক্তি হিসেবে নিজেদের সঠিক স্থান দাবি করার সময় এসেছে। কেউ কি কখনো ভাবতে পেরেছে যে, বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত সাফল্যের বেশিরভাগ অবদান 'পর্দার পেছনে থাকা' গ্রামীণ নারীদের? তাহলে তাদের কেন কৃষকের মর্যাদা দেওয়া হবে না? কেন তারা কৃষকের 'সহকারী' হয়ে থাকবে? কৃষি ঋণের সুবিধা দেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড 'নারী কৃষক' নামের আইনি পরিভাষা চালু করেছে। সেখানে কৃষক হিসেবে নারীরা কৃষি কার্ড পাওয়ার অধিকারী হবে। যাতে তারা বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, যেমন- সার, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অন্যান্য উপকরণ বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পেতে সক্ষম হয়।
যাই হোক, এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য পরিষ্কারভাবে জাতীয় নির্দেশিকা, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করা দরকার। যার মধ্যে আছে নারীর স্বাক্ষরতার হার বাড়ানো, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নারীর অংশগ্রহণকে সমর্থন করা। ভূমির মালিকানার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) সঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ নারীর নিজের জমি নেই। ভূমির মালিকানা নারী ক্ষমতায়নের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ যা নারীর আত্মবিশ্বাস, নিজের মূল্য ও মর্যাদা বাড়াবে। নারীদের ওপর কাজের যে দ্বিগুণ বোঝা, সেটা কমানোর জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। উন্নয়ন পরিকল্পনায় গ্রামীণ এলাকায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, সাশ্রয়ী রান্নার চুলা ও পানি সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তাদের সামাজিক রীতি ও অনুশীলন থেকে বেরিয়ে এসে নারীদের ঘরের কাজে সহায়তা করা উচিত।
২০৪০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য এবং সব নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির কারণে গ্রামীণ নারীর অবদানকে উৎপাদনশীল শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। আজ বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে তার অপরিহার্য অংশ হিসেবে গ্রামীণ নারী ও মেয়েশিশুরা অন্তর্ভূক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাদের আর পুরুষের সহায়ক হিসেবে পর্দার আড়ালে কাজ করা কিংবা পরিবারের দ্বিতীয় সারির সদস্য হিসেবে বসবাস করা উচিত নয়। এখন তাদের জেগে ওঠার সময়, সমস্বরে আওয়াজ তোলার সময়। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের জন্য সমান অংশীদার হিসেবে অধিকার দাবি করার সময়।
শাহীন আনাম: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'র নির্বাহী পরিচালক
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments