ছাত্রলীগের পদতলে গণতন্ত্র কি চাপা পড়ে গেল?

আবারও ছাত্রলীগ পত্রিকার শিরোনাম দখল করে নিয়েছে। গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি লাঠি, লোহার রড ও রাম দা নিয়ে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মীর ওপর হামলা চালায়। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা চালালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে ওই ঘটনা ঘটে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েক ঘণ্টা দফায় দফায় ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলে। ফলে পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভিডিও ফুটেজ ও ছবিতে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্দয়ভাবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিটিয়েছেন। এ ঘটনায় নারীসহ ছাত্রদলের প্রায় ৩০ জন আহত হন।
মাথায় হেলমেট ও হাতে লাঠি নিয়ে বৃহস্পতিবার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। হামলায় সাংবাদিক ও আইনজীবীসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন। ২৬ মে, ২০২২। দোয়েল চত্বর। ছবি: সংগৃহীত

আবারও ছাত্রলীগ পত্রিকার শিরোনাম দখল করে নিয়েছে। গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি লাঠি, লোহার রড ও রাম দা নিয়ে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মীর ওপর হামলা চালায়। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার চেষ্টা চালালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে ওই ঘটনা ঘটে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েক ঘণ্টা দফায় দফায় ধাওয়া পালটা ধাওয়া চলে। ফলে পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ভিডিও ফুটেজ ও ছবিতে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্দয়ভাবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিটিয়েছেন। এ ঘটনায় নারীসহ ছাত্রদলের প্রায় ৩০ জন আহত হন।

ছাত্রদল এমন কী করেছিল, যে তাদেরকে এভাবে পেটাতে হবে? তাদের একজন নেতা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন। বিষয়টিকে পরিষ্কার করার জন্য তারা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করতে চেয়েছিল। গত ২২ মে রাজু ভাস্কর্যের কাছাকাছি আয়োজিত এক মিছিলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, সেটার জন্য তার সমালোচনা করেন। তার মন্তব্য ছাত্রলীগকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। আর সেদিন সাইফ তার মন্তব্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কিছু বলার আগেই ছাত্রদলের সদস্যদের পিটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হয়। এর দুই দিন পর যখন তারা হামলার প্রতিবাদে মিছিল বের করার চেষ্টা করে, ছাত্রলীগ সদস্যরা আবারও তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার হাইকোর্ট এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয় এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্যকে ধাওয়া করে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রায় ৫০ জন আহত হন এবং হামলার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদল এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের আক্রমণ করতে শুরু করে।

ছাত্রলীগ নেতারা তাদের প্রথম হামলার কারণ ব্যাখ্যা করে জানান, 'প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা' তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে 'অপরাধমূলক কার্যক্রমের' বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন জানান, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ বজায় রাখার জন্য' এটা করা হয়। তিনি সতর্ক করেন, সকল 'সন্ত্রাসীকে' সমূলে উৎপাটন করা না পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগকে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে?  সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা কী? বস্তুত, এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ছিল পুরোপুরি ধোয়াশাচ্ছন্ন। প্রথমত, তারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল ছাত্র সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, তারা দ্বিতীয় দিনের হামলা প্রতিরোধ করার জন্য কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেটা করেছে তা হলো শাহবাগ থানায় কিছু অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা। অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ কর্মীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবং সেগুলো সংবাদপত্রেও স্থান পায়, কিন্তু মামলার অভিযোগে তাদের কথা বলা হয়নি। অবশেষে, ছাত্রলীগের দায়ের করা মামলাগুলোতে ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের নাম দেওয়া হয় এবং তাদের কয়েকজনকে আটকও করা হয়।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর, ২০১০ সাল থেকেই ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে রয়েছে। তাদেরকে সব আবাসিক হল থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং তাদেরকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হতো না। কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয় না। তবে ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ ডাকসু নির্বাচনের কারণে ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। প্রায় ২৮ বছরের শীতনিদ্রার পর ২০১৯ সালের মার্চে ওই নির্বাচন হয়। তখন থেকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে ছোটখাটো মিছিল ও সমাবেশ করতে দেখা গেছে। তবে গত দুই বছরের বেশিরভাগ সময় করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল।

গত সপ্তাহের ঘটনায় ছাত্রদলকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। তারা যাতে আবার ফিরে আসতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করছে ছাত্রলীগ। এতে কি ছাত্রদলের সভা-সমাবেশের অধিকার খর্ব হচ্ছে না? শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা একটি মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক জীবনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আইনসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।'

কিন্তু যেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের কর্মসূচি বানচাল করে দেওয়া হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক রীতির বিরুদ্ধে যায়। ব্যাপারটা এমন, যেন ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করাটাই অপরাধ; তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা কোনো অপরাধ নয়। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কারণে একটি দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারে বাধা দেওয়া যায় না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে এটি রাজনৈতিক ভিন্নমতকে ধারণ করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গত ১২ বছরে দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একচেটিয়া আধিপত্যের অধিকারী ছাত্রলীগের এ বিষয়টিতেই রয়েছে সীমাবদ্ধতা। বছরের পর বছর তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে তারা তাদের মূল সংগঠনের নেতাদের প্রতিশ্রুতিকে মূল্য দেয় না। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিরোধী দলের মিছিল ও সমাবেশে বাধা দেওয়া হবে না। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বহু বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের পর, অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু অন্যদের প্রতি ছাত্রলীগ সদস্যদের মনোভাব এটাই ইঙ্গিত করে যে, তেমন কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। ছাত্রলীগ শুধু বিরোধী পক্ষের পরিসর কমাচ্ছে না, একইসঙ্গে এই ছাত্র সংগঠনের জন্য দুর্নাম কুড়াচ্ছেন—যে সংগঠনটি আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে।

 

ওয়াসিম বিন হাবিব: ডেপুটি প্ল্যানিং এডিটর, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
interim government's dialogue with BNP

BNP wary of constitutional vacuum

The BNP appears to be apprehensive about the sudden controversy over the resignation letter of ousted prime minister Sheikh Hasina

8h ago