
ফের আলোচনায় জাতীয় পার্টি। বলা হয়, যখনই জাতীয় পার্টির ভেতরে কোন্দল বাড়বে বা রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে থাকবে, বুঝতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে দশম সংসদে জাতীয় পার্টি দেখিয়েছে, কী করে 'সরকারি বিরোধী দল' হতে হয়।
এবার দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ইস্যুতে। এই মুহূর্তে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ। কিন্তু এই চেয়ারে বসতে চান তার দেবর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, সংক্ষেপে জি এম কাদের।
তবে প্রসঙ্গত আরও কিছু বিষয়ও সামনে আসছে— যা আগামী দিনের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে; বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠন ও ভাঙনে এই দলটি কী করবে, তা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ জাতীয় পার্টি বরাবরই একটি 'আনপ্রেডিকটেবল' দল হিসেবে পরিচিত। যেমন 'আনপ্রেডিকটেবল' ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ।
১৯৮৬ সালে গঠিত এই দলটি এখন ৪ ভাগে বিভক্ত। এরশাদের নেতৃত্বে ছিল মূল দল (প্রতীক লাঙল, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নম্বর ১২)। তার মৃত্যুর পরে মূল দলের নেতৃত্ব নিয়েই এখন দেবর-ভাবির লড়াই। আবার এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশাও হালে বেশ সক্রিয় বলে মনে হচ্ছে। রাস্তার পাশে তার ছবি সম্বলিত পোস্টার চোখে পড়ে। সাবেক স্বামী এরশাদকে নিয়ে যিনি লিখেছিলেন দুটি আলোচিত বই, 'শত্রুর সঙ্গে বসবাস' ও 'স্বৈরাচারের প্রেমপত্র'। সেখানে তিনি এরশাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, বিয়ে, রাজনীতি ও টানাপড়েন নিয়ে নানা কথা লিখেছেন।
গত ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনায় বিদিশা বলেছিলেন, 'জাতীয় পার্টিতে চমকের পর চমক আসবে।' কয়েক মাস পরেই তার সন্তান এরিকের বয়স ২১ হবে উল্লেখ করে বিদিশা বলেন, ভুলে গেলে চলবে না, এরশাদ সাহেব সেনা পরিবারের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। এরিক আজ একা না। এরিকের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার এবং এরশাদকে যারা ভালোবাসে, তারা আছে।
প্রসঙ্গত, এরশাদের সঙ্গে বিয়ের পর বিদিশা জাতীয় পার্টিতে পদ পেলেও বিচ্ছেদের পর তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরশাদের মৃত্যুর পরে তিনি তার পুত্রকে নিয়ে ফের জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় হতে চাচ্ছেন— সেটি পরিষ্কার।
এরশাদের জীবদ্দশাতেই দলটি ৪ ভাগে ভাগ হয়েছে। মূল দলের বাইরেও রয়েছে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি–জেপি (প্রতীক বাইসাইকেল, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নম্বর ২); নাজিউর রহমান মঞ্জুরের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (প্রতীক গরুর গাড়ি, নিবন্ধন নং ১৮), যার বর্তমান সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ; এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (প্রতীক কাঁঠাল, নিবন্ধন নং ২৮), যার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডা. এম এ মুকিত।
এইচ এম এরশাদ জীবিত থাকাকালেই জাতীয় পার্টির ভেতরে নানারকম সংকট দানা বাঁধছিল, যা তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরও তীব্র হয়েছে। সবশেষ গোল বেঁধেছে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ইস্যুতে।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরে ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছোট ভাই জি এম কাদের ২ জনই নিজেকে দলটির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন। এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন জি এম কাদের। উপরন্তু এই সময়ে তারা ২ জনই সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হতে চেয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন। তখন রওশন ও কাদেরের মধ্যে একটা সমঝোতা হয় যে, রওশন হবেন বিরোধী দলীয় নেতা আর জি এম কাদের হবেন বিরোধী দলীয় উপনেতা ও দলের চেয়ারম্যান। ওই বছরের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলে ৩ বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান হন জি এম কাদের।
কিন্তু সম্প্রতি জি এম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা বানানোর জন্য দলের সংসদীয় বোর্ড স্পিকারকে চিঠি দেয়। শুধু তাই নয়, তাকে বিরোধী দলীয় নেতা না বানালে জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে যাবেন না বলেও হুমকি দেন। তবে ৩১ অক্টোবর জানা যায়, স্পিকারের আশ্বাসে তারা সংসদে যাচ্ছেন। বিদিশার ভাষায় এটিও হয়তো 'চমক'। কিন্তু এখানেই কি শেষ?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য করে অবৈধ অর্থ আদায়ের যে অভিযোগ এনেছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী, সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আরেকটি খবরে বলা হয়, এরশাদের সই জাল করে জি এম কাদেরের পার্টির চেয়ারম্যান হওয়ার অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদের বরাতে খবরে বলা হয়, জি এম কাদের এখন আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নন। সারা দেশে পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের করা ৫-৬টি মামলার আদেশ বা নির্দেশে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে তার (জি এম কাদের) রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে; বিশেষ করে জি এম কাদের যে গুরুতর অপরাধ করেছেন (এরশাদের সই জাল করে) তাতে তিনি আর জাপার চেয়ারম্যান পদে থাকতে পারেন না।
রওশনের মুখপাত্রের দাবি অনুযায়ী জি এম কাদের এখন আর দলের চেয়ারম্যান নন। তাহলে চেয়ারম্যান কে? কাউন্সিলের আগে কাউকে নতুন চেয়ারম্যান বলা যায়? অথবা চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিয়ে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কি করা হয়েছে? হয়নি। কারণ জাতীয় পার্টি এমন একটি দল যে এখানে যেকোনো সময় যেকোনো সিনিয়র নেতা যেকোনো কিছু বলতে পারেন এবং এই দলে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।
যেমন: মূল দলে এখন কমিটি ৩টি। জি এম কাদের বর্তমানে পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা; সাবেক স্ত্রী বিদিশা নিজেকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আরেকটি কমিটি করেছেন; আবার সম্প্রতি রওশন এরশাদ নিজেকে আহ্বায়ক করে ৮ সদস্যের আরেকটি কমিটি ঘোষণা করেছেন। এই কমিটি আগামী ২৬ নভেম্বর দলের দশম জাতীয় কাউন্সিল ডেকেছে। আবার রওশন এরশাদের এই আহ্বায়ক কমিটিকে সমর্থন দিয়েছে বিদিশার কমিটি। এরকম অদ্ভুত ঘটনাকে 'চমক' বলাই বোধ হয় শ্রেয়।
যেদিন রওশন এরশাদের এই কমিটি ঘোষণা করা হয়, সেই রাতেই দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের এই কমিটি গঠনকে সম্পূর্ণ অবৈধ, অনৈতিক ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে দাবি করেন। পরে জাতীয় পার্টির ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৪ জনের সম্মতি নিয়ে জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করার প্রস্তাব করা হয় এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে সই করেননি কেবল রওশন এরশাদ ও তার ছেলে সংসদ সদস্য সাদ এরশাদ। তার মানে এখন এটা স্পষ্ট যে, জাতীয় পার্টির সংসদ সদ্যদের মধ্যে রওশন ও সাদ বাদে সকলেই জি এম কাদেরের পক্ষে আছেন। তবে যেহেতু দলটির নাম জাতীয় পার্টি, ফলে এটিও হয়তো শেষ কথা নয়।
প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবির লড়াইটা কেন নতুন করে চাঙ্গা হলো এবং যে দলকে মূলত 'সরকারের অনুগত বিরোধী দল' বলে আখ্যা দেওয়া হয়, সেই দলের চেয়ারম্যান হঠাৎ করে সরকার বিরোধী সুরে কথা বলছেন কেন?
জি এম কাদের হয়তো চাচ্ছেন, বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করতে, যাতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় পার্টি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। গত ২৯ অক্টোবর জামালপুর জেলা জাতীয় পার্টির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর থেকে তাদের মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ দেখা যাচ্ছে না। আমরা বন্ধু হিসেবে তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তারা বন্ধু হিসেবে আমাদের গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারা সর্বপ্রথম আমাদের বানালো অঙ্গ সংগঠন, এরপর বানালো চাকর। এখন জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ ক্রীতদাস বানাতে চায়।
কিন্তু রওশন ও তার অনুসারীরা হয়তো সরকার বিরোধী অবস্থান নিতে চান না। তারা বরং অতীতের মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটেই থাকতে চান। তারা সরকার বিরোধী জোটে গিয়ে ঝুঁকি নিতে চান না। তবে জাতীয় পার্টির যে অতীত কর্মকাণ্ড— তাতে জি এম কাদেরও যদি শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারেন যে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসছে, তখন তিনি বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবেন কি না বা জোট করলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসবেন কি না— তাও হলফ করে বলা মুশকিল।
জাতীয় পার্টি এবং দলটির প্রয়াত নেতা এইচ এম এরশাদ সম্পর্কে রাজনীতির মাঠ ও জনপরিসরে যে পরিমাণ রসিকতা চালু আছে, সেটি অন্য কোনো দল নিয়ে নেই। যে কারণে এখন দলটির নেতৃত্ব নিয়ে যা হচ্ছে, সেটির পরিণতি কী— তা যেমন আগেভাগে বলা মুশকিল, তেমনি দলটির ভেতরে এই মুহূর্তে যা কিছু ঘটছে, তার কতটুকু সিরিয়াস আর কতটুকু রসিকতা, সে বিষয়েও উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। তবে এটা ধারণা করা অমূলক নয় যে, ৪ ভাগে বিভক্ত জাতীয় পার্টি হয়তো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরও একটি ভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে। অথচ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে গিয়ে জাতীয় পার্টি হতে পারতো দেশের সত্যিকারের তৃতীয় শক্তি। কারণ বাংলাদেশে কট্টর ডানপন্থা ও কট্ট বামপন্থার প্রতি সাধারণ মানুষের যে খুব বেশি সমর্থন নেই, সেটি স্পষ্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে গিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরির যে সম্ভাবনা জাতীয় পার্টির ছিল, সেটি দলটির নেতারাই ধ্বংস করেছেন।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments