ফিচার

ভালো বই নির্বাচন করার উপায়

পড়ার গুরুত্ব অনেক। বিষয়টি বোঝাতে বহু উপদেশ ছোটবেলা আমরা পেয়েছি। কিন্তু কি বই পড়বো? সব পড়বো নাকি ভালো মন্দ বাছাই করে পড়বো? ভালো মন্দ বাছাই করতে হলে তার মানদণ্ড কী হবে? কি কি তালিকায় রাখবো আর কি বাদ দিব-তা ঠিক করা বড় মুশকিল। 

একজন ধার্মিক বলবে তাদের বইগুলো পড়তে, পুঁজিবাদ বলবে তাদের বই সেরা, সমাতান্ত্রিক তাদের বই। তাছাড়া বামপন্থী বনাম ডানপন্থী, উদার বনাম কট্টর, সাদা বনাম নীল, ইত্যাকার বিভাজিত লোকেরা তাদের ঘরাণার বই পড়তে বলবে। সুতরাং একেক গ্রুপের মানদণ্ড নির্ধারণ একেকরকম। পৃথিবীতে কোটি কোটি বই আছে। সব বই পড়ে শেষ করা এক জীবনে সম্ভব নয়। আবার সেরা বইগুলো না পড়ে ভালো পাঠকরা মরতে চায় না। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই। সেটা হলো বেছে বেছে বই পড়া। 

তবে এ কথা নিশ্চিত বই নির্বাচনের কোনো শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। বই পড়ে পড়েই ভালো বই খুঁজে নিতে হবে। ফকনার বলেছেন ভালো বই কোনটি তা বুঝতে হলে পড়েই বুঝতে হবে। কাঠমিস্ত্রি যেমন তার গুরুর কাজ দেখে দেখে, নিজে কাজ করতে করতে, একসময় বুঝে যায় কাঠের ফিনিশিং কেমন হবে, কোন কাঠের কোন ধরণের কাজ ফুটবে, কোথায় কোনটা খাপ খাবে। পাঠকও পড়তে পড়তে বুঝে যায় কোন বইটি ভালো। প্রসঙ্গত কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া যায়।

১. পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিগণ মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেন বা লিখেন। তাদের বলা ও লেখাতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স আসে। যেগুলো তাদের কাজে লেগেছিল। সেসব থেকেও নিজের পছন্দের বই বের করা যায়।

.কিছু বই আছে ক্লাসিক। তা সবকালেই সমাদৃত। ক্লাসিক বই বাছাই করা সহজ। যেসব বই যুগের পর যুগ টিকে আছে সেসবের তালিকা করে তা থেকে পছন্দমতো পড়া যেতে পারে। 

. প্রয়োজনে কেউ অনলাইনের হেল্প নিতে পারে, যেখানে আপনার পছন্দ অনুসারে বিভিন্ন বই বা রিভিউ ও স্টার মার্কস দেওয়া থাকে। যেমন the book seer, goodreads, Whichbook, Penguin Classics এরকম নানান সাইট রয়েছে যেখান থেকে ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়।

. সাহিত্য বিচিত্রা, সাহিত্য ম্যাগাজিন, দৈনিক ও মাসিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় অনেক সাক্ষাতকার, প্রবন্ধ ও লেখা আসে। সেখানে বিভিন্ন লেখক ও বই নিয়ে আলোচনা করে। এসব পড়তে গিয়ে যদি কোনো বইয়ের রেফারেন্স মনে ধরে, সেই বই পড়া যায়। 

. অনলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন বা সাহিত্যমেলায় আড্ডা হয়, সেসব শুনতে, দেখতে দেখতে, অংশ নিয়েও ভালো বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। 

. সামাজিক মাধ্যমে বা পত্রিকাতে যে লেখকের লেখা ভালো লাগে ও চিন্তায় দোলা দেয় এবং সুখপাঠ্যের আনন্দ দেয়- তাদের বই কাছে নিয়ে দেখা যায়। 

. লাইব্রেরিতে বা বই কিনতে গেলে বইয়ের কাভার, ফ্ল্যাপ, কাগজ ও ছাপর মান, টেক্সট, ফন্ট ও স্পেসের ধরণ দেখে এবং বইয়ের কিয়দংশ পড়েও একটি বই সম্পর্কে ধারণা করা যায়, বইটি কেমন হতে পারে তা বোঝা যায়। এ থেকে অনুমান করে বই বোদ্ধারা ভালো বই চিনে ফেলতে পারে।

৮. বইয়ের যেমন নানান ট্যাক্সোনোমি আছে, লেখকদের মধ্যেও আছে নানান ধরণ। যেমন প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সাহিত্যিক, কবি, কথাশিল্পী, ছড়াকার, গীতিকার ও গবেষক। তাদের প্রিয় বইগুলোও নির্বাচন করা যায়। 

তবে  প্রত্যেক পাঠকের রয়েছে আলাদা রুচি, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও মনোভাবের ভিন্নতা। যে যেই ঘরানার, একজন পাঠককে টানবে সে ধরণের বই, সেটা পড়েই আনন্দ পাবেন তিনি। একজন বিখ্যাত ব্যক্তির রেফার করা বইও একজন পাঠকের কাছে ভালো না লাগতে পারে। কোন বই যে কোন পাঠককে কবজা করবে তা সরলীণীকরণ করে মুশকিল।

পদ্মা ব্রিজের মতো বড় ব্রিজ করতে চাইলে বিশ বছরে করা যাবে, চাইলে ১০ বছরে করা যাবে আবার অর্থ, জনবল ও পরিকল্পনা থাকলে ৩ বছরেও হয়তো করা যাবে। বই পড়তে পড়তে একসময় বই চেনার চোখ ও মনন তৈরি হয়। ধীরে ধীরে রুচি ও মান তৈরি হয়, বোধ ও প্রজ্ঞা তৈরি হয়। তখন একজন পাঠক বুঝেন কোন বই পড়তে হবে। গাইতে গাইতে গাইন, পড়তে পড়তে পাঠক। ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ নাবোকফ ভালো পাঠক হওয়ার জন্য কিছু গুণের কথা বলেছেন। যেমন ভালো পাঠক মাত্রই বুক ক্লাবের সদস্য হবে, গল্পটির চলচ্চিত্রায়িত রূপ দেখতে পাবে, স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন হবে, হবু লেখক হবে, রসবোধ থাকবে, গল্পের চরিত্রের সাথে একাত্ম হবে ইত্যাদি। 

তাহলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ভালো বই চিনতে হলে ভালো পাঠক হতে হবে। হুমায়ুন আহমেদ এক নির্জন দুপুরে হেঁটে হেঁটে প্রতিবেশী শুক্লাদির বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন। শুক্লাদি তাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম ক্ষীরের পুতুল। সেই বই হুমায়ুনের জীবন পাল্টে দিল। দুপুরে বা অবসরে ঘুরতে ভালো লাগে না। শুধু গল্পের বই তার পড়তে ভালো লাগতো। মুরাকামির ভাষায় '' যে বয়সে মানুষ আরাম করে, হেসে খেলে কাটায়, সেসময় আমি কাজ করতে করতে অবসর পেতাম না। যেটুকু পেতাম বই পড়তাম। এতেই সমস্ত সুখ খুঁজে পেতাম, সেই আনন্দ আর কেউ কেড়ে নিতে পারে নি''। 

জর্ডানের ভাষ্যমতে ''কেউ যদি জাগতিক কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তাহলে তার উচিত গল্পসমৃদ্ধ বই খুলে বসা। এই একা হওয়ার বাসনাই তাকে পাঠক হিসেবে গড়ে তুলবে।'' লেখক গবেষক অ্যাপলের্য়াড বলেছেন, একজন মানুষের যদি ধৈর্য, জ্ঞানের প্রতি স্পৃহা, অনুপ্রেরণা, অনুসন্ধান করার গুণ থাকে তবে তিনি দ্রুত পাঠক হয়ে উঠবেন। ভালো পাঠকের উপরোক্ত গুণে গুণান্বিত যারা তারা স্বভাবতই নিয়মিত বই পড়ে। যারা নিয়মিত বই পড়তে পড়তে ভালো পাঠক বনে যান, তাদের জন্য ভালো বই চিনতে কোনো সমস্যা হয় না।

Comments

The Daily Star  | English

Govt issues ordinance amending Anti-Terrorism Act

Activities of certain entities, and activities supporting them can now be banned

40m ago