শিক্ষাক্ষেত্রে এআই: গবেষণায় নৈতিক দ্বন্দ্ব ও নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা

গত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বেশ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে আমাদের কাজ এবং অধ্যবসায়ে। এক সময় যেটা ছিল প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ, এখন তা বর্তমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে গবেষণায় এআই-ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা তথ্য সংগ্রহ করছেন, রিপোর্ট-ক্লাসরুমের নানা কাজ করছেন।
অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর মনে হলেও, এখানেই তৈরি হচ্ছে একটি নৈতিক সংকট। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণায়—যেখানে চিন্তা, যুক্তি আর নিজের অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
এখন প্রশ্ন উঠছে, একজন শিক্ষার্থী কিংবা গবেষক যদি গবেষণার জন্য তথ্য বিশ্লেষণ, লেখার কাজে এআই ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি কি আদৌ নিজের চিন্তা বা শ্রমের প্রতিফলন দেখাতে পারছেন?
গবেষণা একজন শিক্ষার্থী কিংবা গবেষকের চিন্তা, বিশ্লেষণ, ও তার মেধার প্রকাশ। একজন গবেষক যখন কোনো গবেষণা শুরু করেন, সেখানে কেবল তথ্য সংগ্রহ নয়, নিজের ব্যাখ্যা, তত্ত্ব, ও ব্যতিক্রমী চিন্তার প্রকাশ ঘটান। অথচ এখন অনেক শিক্ষার্থী চ্যাটজিপিটি, জ্যাসপার এআই এবং এমনকি এআই চালিত রেফারেন্স টুলস ব্যবহার করে একটি পুরো প্রবন্ধ তৈরি করে ফেলছেন। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা গবেষণার মৌলিকতা ও নৈতিকতা, সেই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এআইয়ের সাহায্যে তৈরি করা এই গবেষণা আসলে কার সৃষ্টি? যদি কেউ পুরো অংশই এআই দিয়ে তৈরি করেন, তাহলে সেটা তো গবেষকের নিজস্ব চিন্তা নয়। এটি শুধু পূর্ববর্তী তথ্যের ভিত্তিতে 'সম্ভাব্য' একটি উত্তর তৈরি করে দেয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজের মেধা নয়, বরং অন্য কারও (বা অন্য কিছুর) প্রস্তুত চিন্তাকে 'চুপিসারে ধার' করে নিচ্ছেন, এমনটাই বলা যায়। এই ধরনের 'অদৃশ্য অনুলিপি'কে চিহ্নিত করা কঠিন, কিন্তু সমস্যাটি বাস্তব।
এই ধার করা চিন্তা বাস্তবে গবেষণার মৌলিকতার বড় ধরনের লঙ্ঘন। এটি শুধু জ্ঞানের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে না, ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীর স্বনির্ভর বিশ্লেষণী ক্ষমতাকেও সংকুচিত করে তোলে। এখানে আরও একটি সূক্ষ্ম বিষয় আছে। গবেষণায় যখন আমরা অন্য কারো লেখা, আগের কাজ, কিংবা তত্ত্ব ব্যবহার করি, তখন সেই কাজের 'সাইটেশন' উল্লেখ হয়। কিন্তু এআইয়ের ক্ষেত্রে আমরা কাকে এই রেফারেন্স তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করব? এআই তো নিজে কোনো লেখক নয়, বরং অগণিত মানুষের ডেটা বিশ্লেষণ করে প্রস্তুত করা একটি অ্যালগরিদম। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, এটি কি মৌলিক? নাকি একটি ছদ্মচিন্তা? আবার এসব টুল শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়। আরেকটি সমস্যা হলো, এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি গবেষণা অনেক সময় 'Untraceable Plagiarism' এ পরিণত হয়, যা আরও বিপজ্জনক।
গবেষণা, চিন্তনের বাইরে কি এআই গ্রহণযোগ্য?
সব কোর্স বা অ্যাকাডেমিক কাজে এআই ব্যবহারকে একভাবে দেখা যায় না। হতে পারে সেটি ভিডিও এডিটিং, ডিজাইন অথবা অ্যানিমেশন কোর্স। এসব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার দক্ষতা বাড়ায় এবং সৃজনশীলতা প্রসারিত করে। আবার ভাষা অনুবাদ কিংবা গবেষণা পুরোপুরি সম্পন্ন করার পর লেখার ধরন আরও সাবলীল করার ক্ষেত্রে এআই সহায়তাকারী টুলস নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এমনসব ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকার, এআই শুধু একটা সহায়ক প্রযুক্তি, নিজ মেধা এবং চেষ্টার বিকল্প নয়।
প্রয়োজন নির্দিষ্ট কিছু নিয়মাবলী
এআই প্রযুক্তিকে এড়িয়ে নয় বরং শিক্ষাক্ষেত্রে এবং গবেষণাকাজেও কীভাবে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে, সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগগুলোয় স্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। প্রথমেই আসে গবেষণার ক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে তারা গবেষণাকাজের কোন ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করতে পারবেন এবং এর লঙ্ঘন হলে বিভাগ কী করতে পারে। পাশাপাশি কোন কোর্সে এআই টুলস ব্যবহার করা যাবে, কোনটিতে নয়, তা প্রতিটি কোর্সের আউটলাইনেই নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুই পক্ষের জন্য এআই ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা ও প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির সাবেক শিক্ষার্থী।
Comments