এবার এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের সামনে কঠিন সময়
এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়নি। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শিক্ষাগত ব্যবধান রয়ে গেছে এবং সেই অবস্থাতেই তারা উচ্চশিক্ষার যুদ্ধে নামতে যাচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বাতিল হওয়া পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হয়েছে তাদের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। অথচ, করোনা মহামারির কারণে তাদের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর ভিত্তি করে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই 'আপস' শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করেছে।
গত ৩০ জুন থেকে শুরু হওয়া চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা ২১ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল। বন্যার কারণে সিলেটে মাত্র তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করায় তৎকালীন সরকার পরবর্তী পরীক্ষাগুলো স্থগিত করে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাকি পরীক্ষাগুলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকে নেওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করে। তবে বাকি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাস দেওয়ার দাবিতে গত ২০ আগস্ট একদল এইচএসসি পরীক্ষার্থী সচিবালয় ঘেরাও করে এবং একপর্যায়ে ভেতরে ঢুকে তালা ঝুলিয়ে দেয়।
ফলে এ বছরের এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয় এবং এসএসসিতে শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এসব পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করা হয়।
এর অর্থ, এই শিক্ষার্থীরা বড় পাবলিক পরীক্ষাকে এড়িয়ে যথাযথ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ছাড়াই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করছেন।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় বিশেষ পরিস্থিতির কারণে অটোপাস দেওয়া এবং সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এ বছর স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। কারণ, এসব পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা সত্য যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মানসিক আঘাতের মধ্যে ছিলেন এবং তারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।'
তিনি বলেন, 'সরকার কলেজগুলোকে বলতে পারত যে তাদের কতজন শিক্ষার্থী আন্দোলনের কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এবং তাদের জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারত। সেটা না করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই প্রশাসনিক আদেশে এমন একটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলো। এটা একটি খারাপ নজির স্থাপন হয়েছে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পরবেন। কারণ সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ার ফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে এমন পরীক্ষার জন্য তারা অপ্রস্তুত থাকবেন।'
এমন উদ্বেগও রয়েছে যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ফলাফলের স্বীকৃতি নাও দিতে পারে। তেমন হলে এই শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
অধ্যাপক মজিবুর বলেন, 'এই শিক্ষার্থীদের এমনিতেই পড়াশুনার গ্যাপ ছিল। হঠাৎ করে পরীক্ষা বাতিল করে আমরা তাদের আরও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছি।'
তিনি জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষাখাতে মনোযোগ দিতে এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করতে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের আহ্বান জানান।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, 'প্রথমে এসএসসি এবং এখন এইচএসসিতে যেভাবে শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়া হলো, তাতে ভবিষ্যতের তাদের লাভের সম্ভাবনা কম।'
অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিলের সমালোচনা করেন রাশেদা। তিনি বলেন, 'অনেক শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পারফরম্যান্সের উন্নতি করার আশায় ছিলেন। তাদেরকে অন্যায়ভাবে সুবিধাবঞ্চিত করা হলো।'
তিনি বিশ্বাস করেন, যে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে চান, তারা বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। এমনকি যারা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে গেলেও তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যবস্থাপনায় হতাশা প্রকাশ করে রাশেদা বলেন, 'শিক্ষাব্যবস্থা হলো সবকিছুর ভিত্তি। কিন্তু আমরা জানি না, কেন সরকার এই খাতকে বঞ্চিত করেছে। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না হওয়ায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এমনকি আমরা আগামী অর্থবছরের শিক্ষা বাজেট নিয়েও সন্দিহান।'
যদিও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার মনে করেন, এ বছর এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় গ্যাপ পরেনি।
তিনি বলেন, 'তারা পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। এর কারণে তাদের পড়াশুনার ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।'
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন বলেন, 'বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন তাদের সনদ গ্রহণ করে সেটা নিশ্চিত করতে সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণ করা হলেও সেটা ট্রান্সক্রিপ্টে উল্লেখ করা হবে না।'
গত ১৫ অক্টোবর চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে সরকার। পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং মোট এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
Comments