এসএসসি-সমমানের ফল: বিপর্যয় না বাস্তবতা

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নাছিমা কাদির মোল্লা হাইস্কুল অ্যান্ড হোমসের শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: জাহিদুল ইসলাম জয়/স্টার

২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে। গত ১০ এপ্রিল শুরু হওয়া এই পরীক্ষায় মোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেন—যা গত বছরের তুলনায় প্রায় এক লাখ কম। এমনকি এ বছর গড় পাসের হারেও বড় ধরনের ধস নেমেছে। 

১৫ বছরে পাসের হার সবচেয়ে কম

এ বছর গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

গত বছর এ হার ছিল ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

২০২৩ সালে এ হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ছিল সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

২০১০ সালে গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৯১ শতাংশের পর কেবল ২০২১ সালেই রেকর্ড ৯৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানে পাস করে। এই সময়ের মধ্যে ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল সবচেয়ে কম ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে সেটাও ছিল এবারের চেয়ে বেশি।

এর আগে, ২০০৯ সালে পাসের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। 

টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে পরীক্ষার ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশের অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথে হাঁটেনি বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

জিপিএ-৫ কমেছে

এ বছর সারাদেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।

সে হিসােবে গত বছরের চেয়ে এ বছর ৪৩ হাজার ৯৭ জন জিপিএ-৫ কম পেয়েছেন।

জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৩ হাজার ৬১৬ জন ছাত্রী এবং ৬৫ হাজার ৪১৬ জন ছাত্র। এবার ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছেন।

বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তোলা। ছবি: টিটু দাস/স্টার

মেয়েরা এগিয়ে

আগের তিন বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও পাসের হারে এগিয়ে আছেন মেয়েরা।

পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৯ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৯ জন, ছাত্র ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৯৭ জন। এদের মধ্যে ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪৫ জন ছাত্রী ও ৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৮১ জন ছাত্র পাস করেছেন।

এ হিসাবে ছাত্রীদের পাসের হার ৭১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

এ বছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি, দুদিকেই মেয়েরা এগিয়ে রয়েছেন।

বিপর্যয় না বাস্তবতা

এ বছর পাসের হারে শীর্ষে আছে রাজশাহী বোর্ড ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ও সর্বনিম্ন বরিশাল বোর্ড ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. শহীদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এবার শহর থেকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা খারাপ করেছে। 

এই বোর্ডে পরীক্ষার মূল্যায়নে গণিত, ইংরেজি ও বাণিজ্য বিভাগে তুলনামূলক ফল খারাপ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,  'আমরা এর কারণ খুঁজছি, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে ভালো ফলাফলের চেষ্টা করা হবে।'

বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর বাবা মনে করেন, 'এবার শিক্ষার্থীদের নানা সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পরীক্ষা দিতে হয়েছে, যার প্রভাব ফলাফলে পড়েছে।'

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তোলা। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রত্না সাহা বলেন, 'এবার নির্দেশ ছিল- শিক্ষার্থীরা যেমন লিখবে, সে অনুযায়ী নম্বর দেওয়ার। এ কারণেই হয়তো ফল খারাপ হয়েছে।'

এই স্কুলের আরেক শিক্ষক রবীন কুমার শীল জানান, অন্যবারে সহনীয় মাত্রায় খাতা দেখার জন্য বলা হতো।

বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ইউনুস আলী সিদ্দিকীর ভাষ্য, এবার ফল বিপর্যয় হয়নি, প্রকৃত মূল্যায়ন হয়েছে। যা বিগত সময়ে ছিল না।

এবারের পরীক্ষায় ফলাফলে ধারাবাহিক এই বিপর্যয়ের কারণ কী, না এটাই বাস্তবতা?

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন মনে করেন, এবারের এসএসসির ফলাফল দেখে সেটাকে মোটাদাগে ফল বিপর্যয় কিংবা বাস্তবতা—কোনোটাই বলা ঠিক হবে না।

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'প্রথমত, এই বাচ্চারা পরীক্ষা দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর। তাদের অনেকেই একধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা থাকারও একটা প্রভাব আছে। স্কুল বন্ধ ছিল। পড়াশুনা ঠিকমতো হয়নি।'

তিনি বলেন, 'দ্বিতীয় কারণ হলো—আগে শুনতাম, পরীক্ষক ও উত্তরপত্র মূল্যায়নকারীদের এক ধরনের অঘোষিত নির্দেশনা দেওয়া থাকতো যে, নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার আমি যতটুকু জানি এবং শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেও যতটুকু জানতে পেরেছি, এই ধরনের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কোনো পরীক্ষার্থী যে নম্বর পাওয়ার যোগ্য, তাকে যেন সেই নম্বরই দেওয়া হয়, সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।'

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বরাবরই সোচ্চার এই অধ্যাপক বলেন, 'এই দুটি কারণ মিলিয়ে হয়তো এমন ফলাফল। তবে আমি এটাকে ফল বিপর্যয় মনে করি না। আমাদের সময় এটাই স্বাভাবিক ছিল। বরং আরও কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করত, ভালো ফলাফল করত।'

'এবার এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এটাও বেশ বড় সংখ্যা,' যোগ করেন তিনি।

Comments