নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি, মোরাল পুলিশিংসহ চলমান ঘটনাপ্রবাহে ‘উদ্বেগ’ জাবি শিক্ষকদের
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থা, নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি, ক্যাম্পাসের ভেতর শিক্ষার্থীদের চলাফেরার ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের 'মোরাল পুলিশিং' নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষকদের একাংশ।
তারা কথা বলেছেন জুলাই আন্দোলনে জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার মতো বিষয় নিয়েও।
এসব বিষয় নিয়ে আজ শুক্রবার জাবি শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, স্বাধীন সেন, এ এস এম আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, রায়হান রাইন, আইনুন নাহার, শরমিন্দ নীলোমি, সৈয়দ নিজার আলম, রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, ধীমান সরকার ও মাহমুদা আকন্দ গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন।
বিবৃতিতে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে বলা হয়, 'শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্টরিয়াল টিমের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি নির্দেশ করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সাবেক শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ভূঁইয়াকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এবং হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সকল সাবেক শিক্ষার্থীর সনদ বাতিলের জন্য প্রশাসনের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসন শীতল ভূমিকা পালন করে আসছে।'
বিবৃতিদাতাদের ভাষ্য, 'প্রশাসনের নীরব ভূমিকা এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রশাসনের এহেন নীরবতা ২০২৪-এর শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী।'
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, 'আত্মপরিচয় গোপন রেখে এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ ধরনের গোপনীয়তা আসন্ন জাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে নানা অস্পষ্টতা তৈরি করতে পারে এবং উক্ত নির্বাচনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।'
এ অবস্থায় 'জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বজায় রাখতে শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোর গুপ্ত রাজনীতি পরিহার করা আবশ্যক' বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে জাবি ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির অধিকাংশ পদে সাবেক শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, 'কমিটিতে বর্তমান শিক্ষার্থী নয় এমন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক স্পিরিটের সঙ্গে বিরোধী।'
এছাড়া সম্প্রতি ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাষিক নিপীড়নমূলক ও হয়রানিমূলক ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান এই শিক্ষকরা। বলেন, 'নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।'
বিবৃতিতে তারা বলেন, 'এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগে শ্রেণীকক্ষে নারী শিক্ষকের প্রতি পুরুষ শিক্ষার্থীদের অশোভন আচরণ প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে বলে জেনেছি, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ এবং নারী সহকর্মীদের জন্য যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'ইংরেজী নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানের নামে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দিবা-রাত্রির যেকোনো সময় সকল শিক্ষার্থীর নিরাপদ অবস্থান ও চলাফেরা নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। নিরাপত্তা বিধানের নামে শিক্ষার্থীদের চলাফেরা ও হলের বাইরে অবস্থান করার সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তার অধিকার ক্ষুন্ন করার শামিল।'
এছাড়া বর্ষবরণের প্রাক্কালে 'ধর্ম বিশ্বাসের ভিন্নতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে' ক্যাম্পাসে কিছু শিক্ষার্থীকে মদ্যপানের অভিযোগে আটক এবং কোনো তদন্ত ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় তাদের ছবি ও নাম প্রকাশ করার মাধ্যমে প্রক্টরিয়াল টিম তাদের 'অতি-প্রতিক্রিয়াশীল, অসংবেদনশীল মানসিকতা' প্রদর্শন করেছে বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। বলা হয়, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের এহেন মোরাল পুলিশিং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা ঢাকবার অপপ্রয়াস বলেই বোধ হয়।'
এই শিক্ষকরা বলছেন, 'স্বৈরাচারী সরকারের পতনের উদ্দেশে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন চলাকালে বিগত ১৫ জুলাই তৎকালীন জাবি উপাচার্যের বাসভবনে সমবেত আশ্রয়প্রার্থী, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার পর প্রশাসনে বদল ঘটলেও এবং দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও তদন্তের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। উক্ত হামলায় শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের অনেকে গুরুতর আহত হন, যাদের কাউকে কাউকে দীর্ঘসময় ধরে নানা শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এরই মধ্যে হামলার মদদদাতা শিক্ষক ও হামলাকারী শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে।'
Comments