‘অপমানের’ অভিযোগে আত্মহত্যার চেষ্টা ও ছাত্রলীগের বিক্ষোভ: নেপথ্যে যা জানা গেল

ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান। ছবি: সিরাজুল ইসলাম রুবেল/স্টার

শ্রেণিকক্ষে 'ছাত্রলীগ নেতা' বলে 'অপমান' করা হয়েছে অভিযোগ তুলে শিক্ষককে ইমেইল পাঠিয়ে ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে 'আত্মহত্যার চেষ্টা' করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। 

তবে, এ ঘটনাকে 'রাজনৈতিক স্বার্থে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা' এবং 'একাডেমিক ঘটনাকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়া হচ্ছে' বলে দাবি করেছেন ওই শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা।  

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আত্মহত্যার বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী এসএম এহসান উল্লাহ ওরফে ধ্রুব। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপসম্পাদক। 

ফেসবুকে তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীমউদ্দিন খানের নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে 'ছাত্রলীগ করার কারণে অপমান' ও 'অন্যায়ের' অভিযোগ তোলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনার বিচার দাবি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কথা জানান।

পোস্ট দেওয়ার পর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ধ্রুব একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন বলেও জানান তারা।

ফেসবুকে এহসান লেখেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সালাম জানবেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার সাথে দেখা করার। আপনার একটা ছবি তোলার। পূরণ হলো না। জীবনের সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। কি আর করা। কিন্তু আপনার কাছে আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার দিয়ে গেলাম।'

তিনি ওই পোস্টে আরও লিখেছেন, 'প্রিয় তানজিম স্যার, আপনার পরে আমার আর কোনো রাগ নেই। ভালো থাকবেন।'

এ ঘটনায় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের বিরুদ্ধে 'আত্মহত্যার প্ররোচনা'র অভিযোগ তুলে বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে ভোরে ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের নির্দেশে সেখান থেকে তারা চলে যান।

ফেসবুকেও অধ্যাপক তানজীমউদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে সোচ্চার হয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

অন্যদিকে গতকাল রাত থেকেই এ ঘটনায় ফেসবুকে কথা বলেছেন ধ্রুব'র সহপাঠীরা। গতকাল ক্লাসে কী হয়েছিল সে ঘটনাও ফেসবুকে তুলে ধরেছেন অনেকে।

ক্লাসের শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন ক্লাসে এহসানের সঙ্গে একজন অভিভাবকের মতো কথা বলেছেন। 'অপমানজনক' বা আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মতো কিছু তিনি বলেননি।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দিন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েকদিন আগে আমি একটি কোর্সের ফিল্ড ট্রিপ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সুন্দরবন ঘুরতে যাই। ধ্রুব (এহসান) তার ব্যাচমেটদের সঙ্গে ফিল্ড ট্রিপে যাননি। তিনি ক্লাসেও নিয়মিত আসতেন না। সে কারণে তাকে আমি ভালোভাবে চিনতাম না। গতকাল ক্লাসের আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে ধ্রুব আমার কক্ষে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে। তার এক নারী সহপাঠীকে নিয়ে সে একটি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে অভিযোগ করে। তার ওই শব্দ শুনে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি যে, "এটা তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এসব কথা আমাকে বলার প্রয়োজন নাই"।'

'ধ্রুব আমাকে জানিয়েছিল যে ওই ছাত্রী তার এক সময়ের ভালো বন্ধু ছিল। কিন্তু সে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে ওই মেয়ে তা প্রত্যাখান করে,' বলেন তিনি। 

'এরপর আমি ক্লাসে চলে যাই। দুটি ক্লাস চলছিল। ধ্রুব প্রথম ক্লাস করেনি। দ্বিতীয় ক্লাসে সে আসে। ক্লাস শেষে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, "তুমি সুন্দরবন ট্যুর নিয়ে আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছ কেন? তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তুমি এত বছর ধরে একসঙ্গে আছো, তাদের নিয়ে একজন শিক্ষকের কাছে এত বাজে কথা বলা যায়, তা আমার কাছে খুবই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।"

'তখন সে আমাকে বলে, "স্যার আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি, আমার কাছে প্রমাণ আছে।" এরপর আমি তাকে বলি, "এখানে এই ক্লাসে সবাই আছে, তুমি কাদের থেকে এসব অসত্য তথ্য শুনেছ, তাদের নাম বলো।" কিন্তু সে কারও নাম বলতে রাজি হয়নি। এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে বেয়াদবি করতে শুরু করে। তার বেয়াদবি দেখে আমি তাকে বলি, "দেখ, তুমি কোনো নেতা কি না, তা আমি জানি না। তবে যদি নেতা হয়ে থাক, তাহলে আমার কিছু যায় আসে না।" এটা বলেই আমি ক্লাস থেকে বের হয়ে যাই,' বলেন তিনি।

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন আরও বলেন, 'আমি যখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন সে আমাকে বলল, "স্যার, ওই মেয়ের বন্ধুরা আমাকে অপমান করেছে, আপনিও ক্লাসে আমাকে অপমান করেছেন, এর জন্য আমি যদি সুইসাইড করি, তাহলে আপনারা দায়ী থাকবেন।" এ কথা শোনার পর আমি তাকে বুঝিয়েছি। বিকেলে দোকানে নিয়ে ফুচকা খাইয়েছি। তার মায়ের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। সন্ধ্যার পর আমি জানতে পারি, সে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে, এরপর থেকে নিখোঁজ। পরে আমি তার মায়ের সঙ্গে আবার কথা বলি। তার মাও আমাকে ফোনে জানিয়েছেন যে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে নিয়ে কল দিয়েছি। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি।' 

'তার ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং আত্নহনন চেষ্টাটা নিয়ে যা শুরু হয়েছে, সেটা নিয়ে আমি খুবই মর্মাহত এবং হতাশ,' বলেন তিনি।

এদিকে ক্লাসে থাকা শিক্ষার্থীরাও গতকালের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এহসানের এক সহপাঠী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে ধ্রুব ক্লাসে আসে, স্যার পড়াতে থাকেন। শেষের দিকে স্যার ধ্রুবকে দাঁড়াতে বলেন এবং বলেন, "এই যে ক্লাসমেটদের সম্পর্কে এত বাজে গুজব তৈরি করলে, তোমাকে এসব কে বলেছে?" স্যার কথাটা ধমকের সুরেই বলেছেন। এরপর ধ্রুব বলে, "স্যার অনেকেই বলেছে।" স্যার বলেছেন, "কারা? নাম বলো।" ধ্রুব বলে, "আমি আপনাকে স্ক্রিনশট দেখাতে পারব, কিন্তু আমার কোনো বন্ধুর নাম বলতে পারবো না।" তখন স্যার বলেন, "না, না,  তোমাকে নাম বলতে হবে।" এরপর স্যার ওকে কয়েকটা ধমক দেন এবং বলেন যে, "বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থীর এটা বোঝা উচিত তার নিজের ক্লাসমেটদের সম্পর্কে কী বলা যায় আর কী বলা যায়না। তুমি ভুলে গেছো আমি তোমার শিক্ষক? একজন শিক্ষকের সামনে তুমি এসব কথা কীভাবে বলো?" 

'এরপর ধ্রুব কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু স্যার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, "তুমি একজনকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার কারণে তুমি তোমার ক্লাসমেটের সম্পর্কে এভাবে কুৎসা রটনা করতে পারো না।" এরপর স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান,' বলেন তিনি।

এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার কোনো সম্পর্কে নেই জানিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে ফারহানা শাহনেওয়াজ লিখেছেন, 'আজকের ক্লাস যারা করেছি, শুধু তারাই জানি ব্যাপারটা একজন শিক্ষকের স্বাভাবিক শাসনসুলভ আচরণ ছিল। আমরা প্রায় ৫০ এর বেশ শিক্ষার্থী এ ঘটনার সাক্ষী। ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে স্যার কোনো কথাই উচ্চারণ করেননি!'

এদিকে গতকাল রাতে এহসানকে খুঁজে পাওয়া ও হাসপাতালে নেওয়ার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত লিখেছেন, 'আমার ভাইয়ের কিছু হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ছাত্রলীগেরও রক্তের মূল্য আছে। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে রক্তের মূল্য আদায় হবে। জয় বাংলা।'

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তানভীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একজন শিক্ষার্থীকে সবার সামনে অপমান করার অভিযোগে ধ্রুব নামের ওই শিক্ষার্থী গতকাল আত্মহত্যার চেষ্টা করে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছি। কোনোভাবেই একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের এধরনের অপমানজনক কথা বলা সমীচীন নয়।'

এহসানের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তার এক সহপাঠী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে এখন মোটামুটি সুস্থ আছে, বাসায় আছে।' 

তিনি আরও বলেন, 'এ ঘটনায় যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা খোলাসা করতে আমাদের ব্যাচ থেকে একটি প্রেস রিলিজ লেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা শিগগিরই ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠাবো।'

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago