মরক্কো জোয়ারে উত্তাল আরব বিশ্ব

ছবি: এএফপি

কাতার বিশ্বকাপ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আরব ও আফ্রিকান দেশগুলোর ফুটবল ইতিহাসে। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে প্রথম আরব ও আফ্রিকান দেশ হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে এই গৌরব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মরক্কো। এমন স্মরণীয় অর্জনে গোটা আরব ও আফ্রিকান বিশ্বকে যেন এক সুতোয় বেঁধেছেন আশরাফ হাকিমি, হাকিম জিয়েখ, ইয়াসিন বোনোরা। অভাবনীয় এই সাফল্যের উল্লাস মানেনি কোনো মানচিত্রের সীমারেখা। মরক্কোর জয় উদযাপন করেছেন ফিলিস্তিন, বাহরাইন ও ইরাকের ফুটবলপ্রেমীরাও।

এবারই প্রথম মতো কোনো আরব দেশে বসেছে ফুটবলের মহাআসর। আর তাতেই বাজিমাত করেছে আরব ও আফ্রিকান দলগুলো। বিশ্বকাপ শুরুর দুই দিনের মাথায় হট ফেভারিট আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দেয় সৌদি আরব। পরদিন ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামে শক্তির বিচারে পিছিয়ে থাকা মরক্কো। নির্ধারিত ৯০ মিনিট অনেকে চেষ্টা করেও ওয়ালিদ রেগরাগির শিষ্যদের জালে বল পাঠাতে পারেননি লুকা মদ্রিচ, ইভান পেরিসিচরা। গত ২৭ নভেম্বর ফুটবল বিশ্বকে রীতিমতো চমকে দেয় মরক্কো। এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনাদের তারকাখচিত বেলজিয়ামকে তারা হারিয়ে দেয় ২-০ ব্যবধানে।

একদিন বাদে আবারও আফ্রিকানদের আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয় ক্যামেরুন। সার্বিয়ার বিপক্ষে দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও দারুণভাবে ফিরে এসে ৩-৩ গোলে ড্র করে তারা। গত ৩০ নভেম্বর আফ্রিকান ও আরবদের অর্জনের খাতায় যুক্ত হয় আরও একটি অর্জন। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়ে সাড়া ফেলে দেয় তিউনিসিয়া। সাফল্যগাঁথা সেখানেই থামায়নি আফ্রিকানরা। দুই দিন বাদে নেইমার-ভিনিসিয়ুসদের ব্রাজিল হেরে যায় ক্যামেরুনের বিপক্ষে।

ছবি: এএফপি

গ্রুপ পর্ব শেষে নকআউট পর্বে জায়গা করে নেয় মরক্কো ও সেনেগাল। শেষ ষোলোতেই বিদায়ঘণ্টা বাজবে এই দুই দলের, বিশ্বকাপে আফ্রিকানদের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নিয়ে এমন ভবিষ্যৎবাণী করেন অনেকেই। দ্বিতীয় রাউন্ডের দ্বিতীয় দিনেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০ গোলে হেরে সেই ভবিষ্যৎবাণীকে আংশিক সত্যে রূপ দেয় সেনেগাল। তবে মরক্কোর ফুটবলারদের নিজেদের ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে তারা।

গৌরবময় এই যাত্রার সমাপ্তি ঘটতে পারতো শেষ আটেই। তবে মরক্কানদের লক্ষ্য ছিল আরও বড়। ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, ব্ররুনো ফার্নান্দেসদের তারকাখচিত পর্তুগালকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েও তাই ঘাবড়ে যায়নি তারা। জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে ফার্নান্দো সান্তোসের শিষ্যদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে আবারও ইতিহাসের পাতায় নাম ওঠায় মরক্কো। ম্যাচটিতে হাকিমি-জিয়েখরা পেয়েছিলেন গোটা আরব বিশ্বের সমর্থন। তাদের জয়ে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়ও।

স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে নিশ্চিত করে ফিলিস্তিনের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন মরক্কোর খেলোয়াড়রা। ম্যাচশেষে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে মাঠেই উদযাপন করেন তারা। এবার তাদের সাফল্যে যেন সেই ভালোবাসারই প্রতিদান দেন ইসরাইলি দখলদারিত্বের শিকার দেশটির সাধারণ জনগণ।

গাজার সবচেয়ে বড় স্পোর্টস হল ঘুরে কাতারের গণমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক ইয়ুমনা এল সাইদ জানান, সেখানে খেলা দেখতে আসা ভক্তরা এই জয়কে দেখছেন সকল আরব দেশের জন্য এক ঐতিহাসিক জয় হিসেবে, 'তারা চিৎকার করেছে, তালি বাজিয়েছে, ড্রাম পিটিয়েছে, গান গেয়েছে। শেষ বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে উদযাপন করতে এবং মরক্কোর জন্য তাদের সমর্থন, আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করতে। অনেক ভক্ত যাদের সঙ্গে আমরা আজ (শনিবার) রাতে কথা বলেছি, তারা আমাদের জানিয়েছে যে এই ম্যাচ তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।'

ছবি: এএফপি

মরক্কোর জয় উদযাপন করেছেন ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ফুটবল সমর্থকরাও। আল জাজিরা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, 'এখানকার মানুষ উদযাপন করছে, রাতভরই তারা উদযাপন করবে। তারা বলছে যে এই জয় অত্যন্ত প্রতীকী। কারণ, এটা কেবল মরক্কোর নয়, গোটা আফ্রিকা মহাদেশ, গোটা আরব বিশ্ব ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের সাফল্য। মানুষজন খুবই রোমাঞ্চিত... তারা জানিয়েছে যে তাদের এমন অনুভূতি হচ্ছে যেন ইরাক ম্যাচটি জিতেছে।'

মরক্কো থেকে সাত হাজার ১৪৫ কিলোমিটার দূরের দেশ বাহরাইনের হুসেনও গর্বিত হাকিমিদের এমন অর্জনে। আল জাজিরার সাংবাদিক সৌক ওয়াকিফকে তিনি বলেন, 'আমি খুবই খুশি। এবারই প্রথম কোনো আরব দেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে এবং এখন একটি আরব দলকে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে পাচ্ছি আমরা। আমি এটাতে খুবই গর্বিত। এটা দারুণ।'

সমগ্র আরব বিশ্ব যখন উদযাপনে মেতেছে, তখন মরক্কানরা নিজেরা বসে থাকবে তা কি করে হয়! পশ্চিম মরক্কোর শহর কাসাব্লাঙ্কা থেকে পাঠানো আল জাজিজার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'এটা পুরোপুরি শিহরণ জাগানিয়া। এখানকার মানুষ নাচছে, উদযাপন করছে এবং এটা রাতভর চলতে থাকবে।'

ছবি: এএফপি

বিশ্বকাপে মাঠে উপস্থিত থেকে হাকিমিদের সমর্থন যোগাতে হাজারও ভক্ত পাড়ি জমিয়েছিলেন কাতারে। দলটির স্মরণীয় সাফল্যে এবার দেখা মিলছে আরেক অভিনব চিত্রেরও। মরক্কোবাসীদের আনন্দে সামিল হতে আফ্রিকা ও আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে ফুটবলপ্রেমীরা যেতে শুরু করেছেন উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে। আল জাজিরা আরও জানিয়েছে, 'দুটি পরিবার, একটি সৌদি আরব থেকে ও অন্যটি কাতার থেকে এখানে চলে এসেছে, মরক্কানদের মাঝে থেকে এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে।'

ফুটবলে ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার থেকে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা আরবদের এমন সাফল্য হাজারগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বকাপের সৌন্দর্য। বিশ্বের সেরা লিগগুলোতে নিয়মিত খেলা তারকা ফুটবলারদের হারের তেতো স্বাদ দেওয়া মরক্কোর ফুটবলাররা সৃষ্টি করেছেন নতুন উদাহরণ, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা।

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

8h ago