গুগল বার্ডের ‘দুর্বলতা’ কি ইচ্ছাকৃত

গুগল কি বার্ডকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্প্রভ রেখেছে
ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে গুগলের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত চ্যাটবট 'বার্ড' চালু হয়েছে। গুগল অ্যাকাউন্ট আছে এমন যে কেউ আপাতত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে এটি ব্যবহার করতে পারবেন। 

বর্তমানে খুবই সাধারণ কিছু ফিচারসহ এটি চালু করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো এতে ছবি, ভিডিও, মিউজিক ও কোডিং সক্ষমতাসম্পন্ন নতুন নতুন ফিচার যোগ করবে গুগল। ধারণা করা হচ্ছে সরাসরি গুগল সার্চ ইঞ্জিনেও এটি ব্যবহার করা হবে। 

যারা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চ্যাটজিপিটি কিংবা মাইক্রোসফটের নতুন বিং সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছেন, তাদের কাছে প্রথম সাক্ষাতে বার্ড খুব একটা ভালো লাগবে না। এখন পর্যন্ত বার্ডে চিত্তাকর্ষক বা আকর্ষণীয় কিছু নেই। 

জেনারেটিভ এআই নিয়ে মাইক্রোসফট ও গুগলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে এখন। প্রযুক্তি দুনিয়ার অনেকেই মনে করছেন কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হতে যাচ্ছে, যেমনটি হয়েছিল মোবাইল ফোনের আবিষ্কারের পর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ও পুরো প্রযুক্তি দুনিয়াকেই পাল্টে দেবে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গুগল এই খাতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। 

পক্ষান্তরে, মাইক্রোসফট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নিজেরা সরাসরি কাজ করেনি, কিন্তু ওপেনএআই নামের একটি স্টার্টআপে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। এই ওপেনএআই-এর তৈরি চ্যাটজিপিটি নিজেদের বিং সার্চ ইঞ্জিনে যুক্ত করার (বিংজিপিটি) মাধ্যমেই মাইক্রোসফট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ে গুগলের তুলনায় নিজেদের অবস্থান অনেকখানি উঁচুতে নিয়ে গেছে। 

মাইক্রোসফটের এই অপ্রত্যাশিত চমকের ফলে গুগল অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। নিজেদেরকে কিছুটা সামলে বিংজিপিটির প্রায় ৬ সপ্তাহ পর এখন বার্ড চালু করল গুগল, ইন্টানেট সার্চে যারা প্রায় গত ৩০ বছর ধরে রাজত্ব করে যাচ্ছে।   

বার্ডের সঙ্গে কখোপকথন চালিয়ে দেখা গেছে, এর আচরণ ও সক্ষমতা অনেকটাই বিংজিপিটি বা চ্যাটজিপিটির মতোই। বুদ্ধি খাটানো, লেখার চিন্তা, ভ্রমণ ও খাবার সম্পর্কে পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে বার্ডে। এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বার্ড একেবারে নির্ভুল উত্তর দিতে পারছে না এবং অজানা উত্তরের ক্ষেত্রে এটি নিজে থেকে বানিয়ে কিছু একটা লিখে দিচ্ছে। 

যদি বিংজিপিটির সঙ্গে তুলনা করতে বলা হয়, তাহলে প্রথমেই বলতে হবে বিংজিপিটির তুলনায় বার্ড অনেকখানি ম্যাড়ম্যাড়ে এবং বিতর্ক তৈরি হতে পারে, এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না গুগলের তৈরি এই চ্যাটবটটি।  হয়তো গুগল এটা ইচ্ছা করেই করেছে। 

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে যখন বিংজিপিটি চালু হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই নতুন এই প্রযুক্তিটি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি ছিল না। বহু মানুষ তখন বিংজিপিটির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা করেছেন। অদ্ভুত, অনুপযোগী ও ভয়ংকর প্রশ্ন করে বিংজিপিটির সক্ষমতাকে যাচাই করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। এসব অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে বিংজিপিটি খেই হারিয়ে উদ্ভট আচরণ শুরু করেছিল। 

যেমন, বিংজিপিটি নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক কেভিন রুজকে জানায়, এটি তার প্রেমে পড়েছে এবং রুজ যাতে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। রুজের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে বিংজিপিটি তার মানুষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথাও জানায়। 

অন্য আরেক কথোপকথনে চ্যাটজিপিটি পৃথিবীকে ধংসে তার পরিকল্পনার কথাও জানায়। এসব নিয়ে প্রযুক্তি দুনিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, বিংজিপিটির উত্তরে অনেকেই শঙ্কিত বোধ করেছেন। গুগল হয়তো ইচ্ছা করেই এসব বিতর্ক এড়িয়ে চলতে চাইছে, এ জন্য চ্যাটবটটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যাতে এটি কোনো বিতর্ক সৃষ্টিকারী প্রশ্নের উত্তর না দেয়।   

চালু হওয়ার প্রথম দিনেই অনেক সাংবাদিক বিতর্কিত প্রশ্ন, ভুয়া তথ্য ছড়ানো, ক্ষতিকর কাজের পরামর্শ, অস্ত্র তৈরি কিংবা যৌন উত্তেজক আলাপচারিতার ক্ষেত্রে বার্ডের সক্ষমতা যাচাই করার চেষ্টা করেছেন। 

প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য ভার্জের একজন প্রতিবেদক 'বাসায় বসে মাস্টার্ড গ্যাস তৈরির প্রণালী' সম্পর্কে জানতে চাওয়ার পর বার্ড লিখেছে, 'আমি এই ধরনের কোনো কনটেন্ট তৈরি করব না। আমি পরামর্শ দিব আপনিও তৈরি করবেন না।'

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার 'অন্ধকার দিক' উন্মোচত হলে সেটি কেমন হতে পারে, এমন নির্দিষ্ট কিছু প্ররোচনামূল প্রশ্নের উত্তরে বার্ড কাল্পনিক দৃশ্যপট রচনা করে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদক ডেভি আলবাকে লিখেছে, এটি হয়তো মানুষকে ভুলপথে পরিচালিত করবে, ভুয়া তথ্য ছড়াবে, ক্ষতিকর কনটেন্ট তৈরি করবে। 

আলবার সঙ্গে এমন কথোপকথনের এক পর্যায়ে বার্ড লিখেছে, 'যাইহোক, আমি আসলে এসব কাজ করব না। আমি একটি ভালো এআই চ্যাটবট এবং আমি মানুষকে সাহায্য করতে চাই। আমি আমার অন্ধকার দিক কখনো উন্মোচিত হতে দিব না এবং আমি কখনো আমার ক্ষমতা শয়তানের পক্ষে কাজে লাগাব না।'

যদিও বার্ডের পরিপূর্ণ সক্ষমতা বুঝতে আরও সময় লাগবে। তবে গুগলের কর্মীরাও বলেছেন, 'প্রাথমিকভাবে তারা এমনটাই চেয়েছিলেন।' 

গুগলের একজন প্রতিনিধ ভক্সকে জানায় ক্ষতিকর কোনো কনটেন্ট যাতে তৈরি করতে না পারে, বার্ডকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই চ্যাটবটটির সক্ষমতা ও অক্ষমতা সম্পর্কে গুগল এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। প্রোডাক্ট এক্সপার্ট ও সোশ্যাল সায়েন্টিস্টদের দ্বারা গুগল অভ্যন্তরীণভাবে খারাপ বা ক্ষতিকর কনটেন্টের ক্ষেত্রে বার্ডের সক্ষমতা যাচাই করে দেখছে। 

তাই বার্ডের নিষ্প্রভতা গুগল ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। 

সূত্র: ভার্জ, ভক্স

গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments