স্মার্টফোন কি বাজার হারাচ্ছে, যা ভাবছে বড় কোম্পানিগুলো

স্মার্টফোন কি বাজার হারাচ্ছে, যা ভাবছে বড় কোম্পানিগুলো
চলতি বছরের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস। ছবি: সংগৃহীত

স্পেনের বার্সেলোনায় গত ২ মার্চ শেষ হলো মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস, (এমডব্লিউসি) ২০২৩। প্রতিবারের মতো এবারও স্মার্টফোন দুনিয়ার বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি ও ফিচার হাজির করেছে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো। 

স্মার্টফোন দুনিয়ায় মন্দাভাব যেন অবশ্যম্ভাবিই ছিল। কোনো কিছুই চিরদিন জনপ্রিয় থাকে না- বিশেষ করে মোবাইল দুনিয়ায়। টেক দুনিয়ার অন্যান্য পণ্যের তুলনায় স্মার্টফোনের উত্থান ও জনপ্রিয়তা ছিল দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে স্মর্টফোনের বিক্রি ছিল পড়তির দিকে। প্রতিষ্ঠিত স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য একটি 'ম্যাজিক বুলেট'-এর সন্ধানে ছিলেন। ফাইভজি প্রযুক্তি এ ক্ষেত্রে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল, কিন্তু এমন প্রযুক্তির দেখা তো আর প্রতিবছর পাওয়া যায় না। মেরামতযোগ্য ফোন তৈরিতে কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন আইন করার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটি বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোন বাজারে কী প্রভাব ফেলবে, তা হয়তো এখনই নিশ্চতভাবে বলা যাচ্ছে না। 

ফোল্ডেবল ফোনের ক্ষেত্রে স্যামসাং নিজেদের অবস্থান অন্যদের তুলনায় সুদৃঢ় করেছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখনো এমন কিছু করতে পারেনি যা দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করা যাবে। 

ডিভাইস কেনার ক্ষেত্রে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর (ক্যারিয়ার) বাণিজ্যিক চুক্তিও বিক্রি বাড়ার ক্ষেত্রে একটি বাধা। সাধারণত অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো বড় বড় নির্মাতারা ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে গ্রাহককে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে ফোন কেনার সুযোগ দেয়। এতে গ্রহকরা ২-৩ বছরে নতুন ফোন কেনে না, যদিও দেরিতে হলেও গ্রাহককে পুরো অর্থই পরবিশোধ করতে হচ্ছে। 

তবে মনে হচ্ছে স্মার্টফোন দুনিয়ায় এই ধারণার আরও আধুনিক ও ব্যবসাবান্ধব চিন্তা কার্যকর হতে যাচ্ছে। 

গুগলের প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সামির সামাত বলেন, 'ডিভাইসগুলো মূলত সার্ভিস হিসেবে বিক্রি হবে, এমন ধারণা নিয়ে সামনে আরও অনেকে কাজ করবেন। আমার মনে হয় ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো মোবাইল বিক্রির পুরো ব্যাপারটিকে একটি সাবসক্রিপশন মডেলের মধ্যে নিয়ে আসবে যেখানে গ্রাহক কম দামে একটি ডিভাইস কিনবে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবহার করবে এবং পরে পুরোনো ফোনটি ফিরিয়ে দিয়ে নতুন আরেকটি নেবে।'

'হার্ডওয়্যারকে সার্ভিস হিসেবে বিক্রি' করার ধারণা সামনের দিনগুলোতে আরও প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যা হয়তো স্মার্টফোনের দুনিয়ায় একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্মার্টফোনে দেখার জন্য সিনেমা, গান কিংবা অন্যান্য সেবাগুলো সাবসক্রিপশনের অধীনে চলে আসতে পারে।' 

যদি ফোনের দাম কমে যায়, তাহলে অনেক গ্রাহক নতুন ফোন কেনার ক্ষেত্রে এত চিন্তাভাবনা করবেন না। ফলে ফোনের বিক্রি বেড়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে ফ্রি পাওয়া যায়, এমন অনেক সেবা কী তখন টাকা দিয়ে কিনতে হবে? হয়তো হবে। যদি সেটি হয়, তাহলে স্মার্টফোনের পেছনে মোট খরচ কী এখনকার চেয়ে বাড়বে? হয়তো বাড়বে। 

তখন বেশি ফোন বিক্রি হওয়ায় স্মার্টফোন বর্জ্যও বেশি তৈরি হবে, যা পরিবেশের জন্য একটি হুমকি।

স্মার্টফোন দুনিয়ায় প্রতিযোগিতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিগুলোর আয় কমেছে। বর্তমানে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে অনেক ভালো মানের ফোন বাজারে পাওয়া যায় এবং এই টাকার মধ্যে অথবা আরও কম দামে দিন দিন আরও ভালো ফোন বাজারে আসছে। ইদানিং একটি 'বাজেট' ফোনেও আগের বছরের সেরা চিপসেট থাকছে, যাতে বাজারে ফোনটির কাটতি বাড়ে। 

ভালো ফোন বেশিদিন টেকে। বর্তমানে ৩-৪ বছরের পুরোনো ফোনগুলোর সঙ্গে যদি ৩-৪ বছর আগে একই সময় ধরে ব্যবহৃত ফোনগুলোর তুলনা করি, তাহলে দেখব, পরিস্থিতি কিন্তু একই রকম নেই। আগে ৩-৪ বছরে স্মার্টফোনে যে নাটকীয় পরিবর্তন আসতো, এখন হচ্ছে না। তার মানে গত কয়েক বছর ধরে স্মার্টফোন দুনিয়ায় উদ্ভাবনের গতি কমে গেছে। আগের বছরের তুলনায় পরের বছরের মডেলে নাটকীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে, এমন স্মার্টফোন শেষ কবে দেখেছেন আপনি? 

স্মার্টফোন নির্মাতা ব্র্যান্ড 'নার্থিং'-এর প্রধান নির্বাহী এবং সহ-প্রতিষ্ঠানা কার্ল পেই বলেন, শুরুর দিকে স্মার্টফোনের বাজার খুব দ্রুত বেড়েছে কারণ তখন এ ক্ষেত্রে অনেক উদ্ভাবন ছিল যা গ্রাহকের জীবনকে অনেক সহজ করেছে। কিন্তু এখন বিক্রি অনেক কমেছে কারণ গ্রাহকের হাতে ইতোমধ্যে যে ফোনটি আছে, সেটিকেই সে যথেষ্ঠ মনে করছে। তাই নতুন অরেকটি ফোন কেনার প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করছে না। 

বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এগুলো কিন্তু সবই ভালো। গ্রাহক এখন কম দামে ভালো ফোন পাচ্ছে, ঘন ঘন মোবাইল না কেনাতে কম বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। করপোরেশনগুলো যদি এই চক্রে (স্মার্টফোন কেনা ও সেটি দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর নতুন আরেকটি কেনা) সন্তুষ্ট থাকতো, তাহলে গ্রাহকের জন্য খুশি হওয়ার কারণ ছিল। কিন্তু আয় কমে যাওয়ায় করপোরেশনগুলো বর্তমান বাজার ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। ভালোভাবে টিকে থাকতে তাদেরও আরও আয় প্রয়োজন।   

গুগলের সামিত বলেন, 'নতুন ফোন সব সময়ই বিক্রি হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে গ্রাহকরা এখন স্মার্টফোনকে তাদের প্রাথমিক কম্পিউটিং ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই এই বাজার নিয়ে নতুন করে ভাবার মতো অনেক কিছু আছে। এই ডিভাইসগুলো দিয়ে কী কী করা সম্ভব, এনগেইজমেন্ট কীভাবে হতে পারে, কী কী সেবাকে কাজে লাগানো যেতে পারে, এবং ডিভাইসগুলোকে কীভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ করা যেতে পারে... এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরই ভবিষ্যতে স্মার্টফোনের বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।' 

অবশ্য এমনটা যে হচ্ছে বা হবে, সেটি কিন্তু এই খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলো অনেকদিন ধরেই জানে। করোনা মহামারির আগে থেকেই বিক্রির হার পড়তির দিকে ছিল, কিন্তু গত ৩ বছরে এই হার আরও তরান্বিত হয়েছে। মহামারির ধাক্কায় সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব, মল্যস্ফিতি, সাপ্লাই চেনে সমস্যা... নানা কিছু এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ব্যবসা বাড়াতে তাই অগ্রগামী চিন্তাশীল কোম্পানিগুলো অন্যান্য খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগ অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো কোম্পানিগুলোকে সফলতাও এনে দিয়েছে। বিভিন্ন ওয়্যারেবলস এবং হোম ডিভাইস প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।  

সিক্স-জি প্রযুক্তির উন্মেষের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই এটিকে ঘিরে নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনবে। প্রথম সিক্সজি পণ্য বাজারে আসতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। সদ্য শেষ হওয়া মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে সিক্সজি প্রযুক্তি নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় একজন আলোচক বলেন, 'প্রথম যে কথাটি মনে রাখতে হবে, সেটি হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি এটি বাজারে আসছে না। ২০৩০ সাল বা এরপর থেকে আমরা সিক্সজির পুরো সুবিধা বুঝতে পারব।' 

কিন্তু তার আগে কী হবে? ফোল্ডেবল ফোন কী কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে? এবারের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস থেকে মনে হচ্ছে প্রায় সব কোম্পানিই চলতি বছর নিজেদের ফোল্ডেবল ফোন বাজারে আনতে যাচ্ছে, শুধু 'নাথিং' ছাড়া। 

নাথিংয়ের প্রধান নির্বাহী বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ফোল্ডেবল ফোন সাপ্লাই চেন থেকে প্রভাবিত হয়ে উদ্ভাবিত। কেউ একজন ওএলইডি ডিসপ্লে উদ্ভাবন করে প্রচুর অর্থ আয় করল। কয়েকবছর পর আরও অনেক কোম্পানি একই রকম ডিসপ্লে বানানো শুরু করল। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মূল উদ্ভাবককে তার ডিসপ্লের দাম কমাতো হলো। কিন্তু কী বিক্রি করে বেশি আয় করার সম্ভব, সেটি তার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল। এরই ধারাবাহিকতায় সে নমনীয় ওএলইডি ডিসপ্লে তৈরি করে বেশি লাভে বিক্রি শুরু করল।'

এবারের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে প্রায় সবাই একটা ব্যাপারে একমত- স্মার্টফোনের উদ্ভাবন থমকে আছে। কিন্তু ঠিক কী করলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তবে এই পরিস্থিতি বদলাতে এবং বিক্রি বাড়াতে সবাই যে যার যার অবস্থান থেকে যানপ্রাণ চেষ্টা করছে, সেটি নিশ্চত। 

সূত্র: টেকক্রাঞ্চ
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

 

Comments