রোবোফিশ: কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের পথে আরেক ধাপ অগ্রগতি

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের তৈরি রোবোফি। ছবি: সংগৃহীত

ধরুন, আপনি অপারেশনের জন্য অস্ত্রোপচার কক্ষের টেবিলে শুয়ে আছেন এবং সেখানে ডাক্তার উপস্থিত নেই। হঠাৎ, একটি যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপারেশন শুরু করলো এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সফলভাবে সেটা শেষ করলো।

চিন্তাটি খানিকটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও এখন এটি বাস্তব। প্রযুক্তির এই যুগে এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে আলাদা জায়গা করে নিচ্ছে রোবটিক্স। একসময় কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জটিল রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে নিরাময়েও ব্যবহৃত হচ্ছে।

রোবটিক্সের শুরু সম্পর্কে একটু বলা দরকার, এ জন্য ফিরে যেতে হবে ১৯৫০ সালের আমেরিকায়। সেসময়ে জর্জ ডিবল নামের একজন মার্কিন উদ্ভাবক 'ইউনিম্যাট' নামের একটি রোবট উদ্ভাবন করেন। 'ইউনিম্যাট' মূলত একটি বিশাল হাতের মতো যন্ত্র, যার মূল কাজ ছিল ভারী জিনিসপাতি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরানো। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোবটিক্স

চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোবটিক্সের যাত্রা গত শতকের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও এর সর্বপ্রথম প্রয়োগ ঘটে ১৯৮৫ সালে। পুমা ৫৬০ নামের একটি রোবট ব্রেন বায়োপসির একদম নিখুঁত ফলাফল তৈরি করতে সক্ষম হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে যেন এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। 

এরপর সময়ের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে নিউরো-মেট, মিনার্ভা, ঈশপ এবং জিউসের মতো রোবটিক সিস্টেম আবিষ্কৃত হয়। যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোবটিক্সকে এক অবিচ্ছেদ অঙ্গ হিসেবে রূপ দেয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোবটিক্স প্রয়োগের শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল জটিল এবং সূক্ষ্ম অপারেশনগুলোকে রোবটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা। এই অপারেশনগুলোতে সুনিপুণ এবং স্থির হাতের প্রয়োজন হয়। হাতের একটু কাঁপাকাঁপি বা একটি ভুল রোগীর জীবন বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বিশেষ করে, হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি ছোট ভুলও অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। 

১৯৯০ এর দিকে বিজ্ঞানীরা হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আবিষ্কার করেন একাধিক রোবট। তবে, ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত এগুলো পরীক্ষাধীন পর্যায়েই ছিল। ২০০০ সালের পর চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে রোবট ব্যবহার শুরু হয়। সিস্টেমগুলোর মধ্যে জিউস, ঈশপ, এবং দ্য ভিঞ্চি সার্জিক্যাল সিস্টেমই ছিল বহুল প্রচলিত।

বিশেষত দ্য ভিঞ্চি সার্জিকাল সিস্টেম সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত এবং সমাদৃত রোবটে পরিণত হয়। এই সিস্টেমে একজন সার্জন কনসোলের সাহায্যে রোবটটিকে কন্ট্রোল করেন। সিস্টেমটি সার্জনের হাতের নড়া-চড়াকে যান্ত্রিক-রূপ দিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর কাটা-ছেঁড়া সম্পন্ন করতে পারে। এতে অপারেশনের ঝুঁকি এবং সময় অনেকাংশে হ্রাস পায়।

কিন্তু, বিজ্ঞানের লক্ষ্যই থাকে সর্বদা নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্যকে ধারণ করেই হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী উদ্ভাবন করলেন রোবোফিশ, তাদের মতে 'বিজ্ঞান এবং প্রকৃতির' এক অসাধারণ যোগসূত্র এটি।

রোবোফিস

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের তৈরি এই 'বায়োহাইব্রিড' রোবটটি মানুষের হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করে স্পন্দন, অর্থাৎ হার্টবিত তৈরি করতে সক্ষম। মাত্র আধা ইঞ্চি লম্বা এই রোবটটি তৈরি করা হয়েছে জেব্রাফিশ নামের এক মাছের আদলে। 

রোবটটি মানুষের হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে নিজের লেজের সাহায্যে কৃত্রিম স্পন্দন তৈরি করে। এই রোবট প্রস্তুত করা হয়েছে কার্ডোমাইসাইটিস নামের একদল বিশেষ কোষ ব্যবহার করে। কোষটি হৃৎপিণ্ডে স্পন্দন তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকে, যার ফলে রোবোফিশ তৈরির জন্য এই কোষই সবচেয়ে উপযুক্ত।

রোবোফিশটি তৈরিতে আরও ব্যবহার করা হয়েছে কাগজ এবং প্লাস্টিক। মাছরূপী রোবটটির পাখনা প্লাস্টিকের এবং মূল কাঠামো কাগজের তৈরি। মাছটির লেজের দুপাশে একজোড়া করে কার্ডোমাইসাইটিস কোষ লাগানো থাকে। আর এর কাজ করার প্রক্রিয়াটিও খুবই সহজ। প্রথমে রোবটটির একপাশের কোষ সংকুচিত হয় এবং সংকোচনের ফলে আরেকদিকের কোষ প্রসারিত হয়। 

এই প্রসারণের ফলে একটি বিশেষ প্রোটিন নিঃসৃত হয় যার কারণে আরেকদিকের সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। এই সংকোচন-প্রসারণ প্রক্রিয়া চলমান থাকে এবং এর ফলে রোবোফিশটি কোনোপ্রকার মানুষের সাহায্য ছাড়াই হৃৎপিণ্ডের মাঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়াকে ক্লোজড লুপ সিস্টেম বলা হয় এবং রোবোফিশটি এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে ১০০ দিন পর্যন্ত কোনপ্রকার মানবসাহায্য ছাড়া চলতে সক্ষম হয়। 

এ ব্যাপারে বিজ্ঞানী-দলের সদস্য কিল ইয়োং লি বলেন, '২ টিস্যুর মাঝখানে থাকা কার্ডিয়াক মেকানো-ইলেকট্রিকাল সিগনালিংকে কাজে লাগিয়ে আমরা এই সিস্টেম তৈরি করেছি। এতে প্রতিবার সংকোচনের ফলে প্রসারণ ঘটবে এবং প্রক্রিয়াটি চলমান থাকবে।' 

সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে যে রোবটটির কর্মদক্ষতা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। রোবোফিশটি শরীরে প্রবেশ করার একমাস পর সাঁতার কাটার গতি, স্পন্দন তৈরি করার ক্ষমতা এবং পেশী সমন্বয়তা ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে রোবোফিশটি সত্যিকারের জেব্রাফিশের মতো সাঁতার কাটার সক্ষমতা লাভ করে।

রোবোফিশটির ব্যাপারে এই উদ্ভাবনের মূল উদ্ভাবক কিট পার্কার জানান, মূলত কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির প্রক্রিয়ার একটি ধাপ হিসেবে রোবোফিশটির উদ্ভাবন হয়েছে। তিনি বলেন, 'কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড এবং হৃৎপেশী তৈরির পূর্ববর্তী কাজগুলোতে মূল লক্ষ্যই ছিল হৃৎপিণ্ডের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য বা হৃৎস্পন্দনের অনুকরণ করা। এখন, আমরা হৃৎপিণ্ডের মূল বায়োফিজিক্যাল কর্মধারা শনাক্ত করছি এবং সেটির ওপর ভিত্তি করে এই রোবোফিশটির উদ্ভাবন করেছি।'

রোবোফিশটি আবিষ্কারের মাধ্যমে কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড তৈরির প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে গেল বলে মনে করছেন কিট পার্কার। তিনি আরও বলেন, 'আমরা এই উদ্ভাবন থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং আমরা এই শিক্ষাগুলো শিশুদের হৃৎপিণ্ডের রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি রিজেনারেটিভ মেডিসিন তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করব। এরপর আমরা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ডের দিকে মনোযোগ দিতে পারব।'

নিঃসন্দেহে, রোবোফিশের উদ্ভাবন চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এমন অগ্রগতি আর ব্যবহার আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলতে পারে যে, একসময় কাউকে আর অন্তত হৃদপিণ্ডের সমস্যায় অকালে মৃত্যুবরণ করতে হবে না, এমনকি কৃত্রিম হৃদপিণ্ডের সাহায্যে বেঁচে থাকবে মানুষ।

 

তথ্যসূত্র: ডেইলি মেইল, নিউ সায়েন্টিস্ট, রোবোটিক্স, দ্য ভিঞ্চি সার্জারি

 

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka airport receives 2nd bomb threat

Operations at HSIA continue amid heightened security

41m ago