যেসব কারণে বুমেরাং হলো কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন
![কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2024/06/11/coca-cola-01.jpg?itok=KDthG_Te×tamp=1718190490)
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোকা-কোলার পণ্য বয়কটের আহ্বান জোরদার হচ্ছে এবং বাংলাদেশের গ্রাহকরাও ক্রমেই স্থানীয় ও বিকল্প পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন।
এই সংকট মোকাবিলায় কোকা-কোলা বাংলাদেশ সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। তবে এই প্রচারণা কেবল তাদের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থই হয়নি, বরং আরও বেশি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঠিকভাবে প্রচারণা চালানো না হলে কী ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে, কোকা-কোলার বিজ্ঞাপনকে ঘিরে চলমান বিতর্ক তার একটি মূর্ত উদাহরণ।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কারখানা পরিচালনা নিয়ে কোকা-কোলা যে দুর্নাম কুড়িয়েছে, এই পরিস্থিতিতে তাদের কিছুটা নমনীয় থাকা উচিত ছিল।
কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন: দুর্বল কাজের একটি কেস স্টাডি
কোকা-কোলা বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনটি পাঠ্যবই পড়ে শেখা তত্ত্বের প্রতিফলন—কীভাবে সংকট মোকাবিলা করা উচিত না। বিজ্ঞাপনের প্রথমেই বিপত্তির শুরু! মানুষের ক্ষোভের কারণ কী, সে সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় বিজ্ঞাপনের প্রথম দৃশ্যেই।
এ রকম সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল ব্যাপারে চিত্রনাট্য ও সংলাপগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। গ্রহণযোগ্য যুক্তি উপস্থাপন কিংবা ভোক্তাদের উদ্বেগ আমলে না নিয়ে অস্পষ্ট ও অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে—যা সরাসরি উপসংহারে নিয়ে যায়, 'এমনকি ফিলিস্তিনেও কোকা-কোলার একটি কারখানা রয়েছে'।
তাড়াহুড়ো করে নির্মাণ করা ও দুর্বল গবেষণার এই বিজ্ঞাপন প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজে আসেনি। বরং বেসুরো গানের মতো স্পষ্ট করেছে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের অনুভূতি কতটা গভীর, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়নি।
কোকা-কোলার আইকনিক বিজ্ঞাপনগুলো: চরম বৈপরীত্য
আইকনিক বিজ্ঞাপন তৈরিতে কোকা-কোলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যেগুলো কেবল দর্শকদের মনে দাগ-ই কাটেনি, বরং কার্যকর বিপণনের ক্ষেত্রে একেকটি কেস স্টাডি হিসেবেও বিবেচিত হয়। সত্তরের দশকে ঐক্য ও সৌহার্দ্যের বার্তা নিয়ে 'শেয়ার এ কোক' প্রচারণা শুরু করে কোকা-কোলা। সে সময় আনমনেই অনেকে গুনগুন করে উঠতেন 'আই'ড লাইক টু বাই দ্য ওয়ার্ল্ড এ কোক'। এরপর থেকে কোকা-কোলা তাদের মানসম্মত বিজ্ঞাপনের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
সে সময় তাদের প্রচারণা সফল হয়েছিল, কারণ এর পেছনে ছিল উল্লেখযোগ্য গবেষণা ও অন্তর্দৃষ্টি, সতর্কতা এবং সুচিন্তিত উপস্থাপন, গভীর মূল্যবোধ ও আবেগ। দর্শকের সঙ্গে আন্তরিক বোঝাপড়া ফুটে উঠতো; বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে অদ্ভুতভাবে যা অনুপস্থিত।
সংকট মোকাবিলায় কার্যকর প্রচারণার মূলনীতি
সংকট মোকাবিলায় প্রচারণা একইসঙ্গে একটি শিল্প ও বিজ্ঞান। এখানে ভারসাম্যপূর্ণ স্বচ্ছতা, সহানুভূতি ও কৌশলগত বার্তা দেওয়া আবশ্যক।
কোকা-কোলার বিজ্ঞাপনটিতে যে ব্যাপারগুলো অনুসরণ করা উচিত ছিল:
দর্শকের মনস্তত্ত্ব বোঝা: খসড়া তৈরির আগে দর্শকের উদ্বেগ এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা এবং যারা প্রভাবিত হতে পারেন, তাদের সঙ্গে প্রকৃত সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। কোকা-কোলার ক্ষেত্রে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ঘিরে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার বিষয়গুলো স্বীকার করা হতো বিচক্ষণতা।
স্বচ্ছ ও সহানুভূতিশীল প্রচারণা: সংকটকালে স্বচ্ছতা ও সহানুভূতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্র্যান্ডগুলোকে অবশ্যই প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে, আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ এবং স্পষ্ট ও যৌক্তিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। কোকা-কোলার বিজ্ঞাপনটি সহানুভূতি প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে এবং জনগণের উদ্বেগ দূর করতে পারে, এমন কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি।
কৌশলগত বার্তা প্রচার: সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন কৌশলগত বার্তার প্রচার, যা হবে সুসঙ্গত, সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ব্র্যান্ডের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিজ্ঞাপনের বার্তা হবে জনগণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার ও সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিমূলক।
অংশীজনদের সম্পৃক্ততা: সংকট মোকাবিলায় ক্রেতা, কর্মচারী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। এই সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকা উচিত; কেবল একটি বিজ্ঞাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত না। বাংলাদেশের ভোক্তা ও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করলে কোকা-কোলা আরও বেশি উপকৃত হতে পারতো।
প্রচারণায় অদক্ষতা কীভাবে একটি ব্র্যান্ডের সুনামের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে, বাংলাদেশে কোকা-কোলার সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যখন সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা করা উচিত, সে সময় ভুল করে বসা কোম্পানি এটিই প্রথম নয় এবং সম্ভবত শেষও নয়। তবে এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ সংলাপ এবং সুস্পষ্ট ও সময়োপযোগী প্রচারণার মাধ্যমে একটি ব্র্যান্ড আরও ভালোভাবে সংকট মোকাবিলা করতে পারে; গ্রাহকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার ধীর প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। এটি একটি ভিন্ন যুগ; যেখানে স্বচ্ছতা ও সাধারণ মানুষের উপলব্ধির ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হয় এবং সংকটের সময় কীভাবে কার্যকরভাবে প্রচারণা চালানো যায় তা জানা এখন কেবল একটি দক্ষতা নয়—প্রয়োজনীয়তা।
অনুবাদ: আহমেদ বিন কাদের অনি
Comments