ওপেনএআইর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যানকে নিয়ে যত নাটকীয়তা
গত কয়েকদিনে ওপেনএআইতে যা হয়ে গেলো, তাকে রোমাঞ্চকর নাটক বললেও কম বলা হয়। এক সপ্তাহেরও কম সময়ে বরখাস্ত হয়ে আবারও চাকরি ফিরে পেলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান। এর মাঝে হয়ে গেছে অনেক নাটকীয়তা।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান। কিন্তু ১৭ নভেম্বর কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই তাকে ছাঁটাই করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ।
এই ঘটনা প্রযুক্তি বিশ্বে বড় বিস্ময়ের জন্ম দেয়। এরপর স্যাম অল্টম্যানকে নিয়োগ দেওয়ার ঘোষণা দেয় মাইক্রোসফট, যারা আবার ওপেনএআইয়ের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী। নানা নাটকীয়তার পর ২২ নভেম্বর তিনি আবারও ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী পদে ফেরার ঘোষণা দেন।
ওপেনএআই গত এক বছর ধরে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে প্রযুক্তি দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত। এই প্রতিষ্ঠানটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক জনপ্রিয় চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির নির্মাতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বর্তমানে সারা বিশ্বে যে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে, তার মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন স্যাম অল্টম্যান। তার নেতৃত্বেই ওপেনএআইয়ের ভ্যালুয়েশন ২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে এক বছরের ব্যবধানে ৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
প্রযুক্তি বিশ্বে নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাইয়ের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, টুইটারের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি, উবারের প্রতিষ্ঠাতা ট্র্যাভিস কালানিক, ইয়াহুর প্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং, ব্ল্যাকবেরির প্রতিষ্ঠাতা মাইক লাজারিডিসকেও তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই করা হয়েছিল।
যেভাবে ছাঁটাই
১৭ নভেম্বর, শুক্রবার সকালে ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য ইলিয়া সাটসকেভার, যিনি আবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিজ্ঞানীও, স্যাম অল্টম্যানকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে গুগল মিটে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা বলেন।
অল্টম্যান শুক্রবার দুপুরে সেই বৈঠকে যোগ দিয়ে দেখেন গ্রেগ ব্রকম্যান ছাড়া ওপেনএআইয়ের বাকী বোর্ড সদস্যরাও সে বৈঠকে উপস্থিত আছেন। এই বৈঠকে অল্টম্যানকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং খবরটি কিছুক্ষণের মধ্যেই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। পরবর্তীতে জানা যায়, এই খবর শুনে অল্টম্যান হতবিহবল হয়ে পড়েন।
কয়েক মিনিট পর ইলিয়া সাটসকেভার ওপেনএআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগ ব্রকম্যানকে 'দ্রুত একটি কলে' যোগ দেওয়ার জন্য মেসেজ পাঠান। এর ৪ মিনিটের মাথায় ইলিয়া একটি গুগল মিটের লিংক পাঠান ব্রকম্যানকে। ওই কলেই ব্রকম্যানকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাকে ওপেনএআইয়ের বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক মিনিট আগে যে অল্টম্যানকে ছাঁটাই করা হয়েছে, সেটিও ব্রকম্যানকে জানানো হয়। ঠিক একই সময়ে অল্টম্যানকে ছাঁটাই করার খবর নিজেদের ব্লগে প্রকাশ করে ওপেনএআই।
ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো প্রযুক্তি বিশ্বই একরকম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কেউ ধারণাও করতে পারেনি এমন একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। বোর্ড সদস্যরা প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগকারীদেরকেও জানাননি। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাত্র এক মিনিট আগে অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলাকে বিষয়টি জানানো হয় এবং তিনি এ সিদ্ধান্তে 'প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ' হন।
ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করেন গ্রেগ ব্রকম্যান। পদত্যাগ করেন প্রতিষ্ঠানটির তিনজন জ্যেষ্ঠ গবেষকও।
স্যাম অল্টম্যানকে ছাঁটাই করার কারণ হিসেবে ওপেনএআইয়ের বোর্ড জানায়, তাদের সঙ্গে স্যামের যোগাযোগের ঘাটতি ছিল এবং বোর্ড মনে করে স্যাম অল্টম্যান ওপেনএআইকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন।
১৮ অক্টোবর ব্লুমবার্গের খবরে বলা হয়, পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে, বিশেষ করে ইলিয়া সাটসকেভারের সঙ্গে অল্টম্যানের মতের তীব্র অমিলের প্রেক্ষাপটেই এই ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
ওপেনএআইয়ের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা মিরা মুরাতিকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস টুইচের প্রতিষ্ঠাতা এমেট শিয়ারকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
গণপদত্যাগের হুমকি ও ফিরে আসার গুঞ্জন
স্যাম অল্টম্যানকে ছাঁটাই করার খবরে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করে বিনিয়োগকারী ও প্রযুক্তি দুনিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে। ওপেনএআইয়ের কর্মীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। ছাঁটাইয়ের দুই দিন পর ২০ নভেম্বর ওপেনএআইয়ের অফিসে 'গেস্ট ব্যাজ' পরে এক্স-এ একটি ছবি শেয়ার করেন অল্টম্যান। এই ছবি দেখে অনেকেই বলতে থাকেন তিনি আবারও আগের পদে ফিরছেন। তবে গুঞ্জন জোরালো হওয়ার আগেই ইলিয়া সাটসকেভার জানিয়ে দেন, অল্টম্যান আর ফিরছেন না।
ওপেনএআইয়ের কর্মী সংখ্যা প্রায় ৭০০। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক কর্মী একটি উন্মুক্ত চিঠিতে পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগ ও স্যাম অল্টম্যানকে পুনর্বহালের দাবি জানায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, অল্টম্যানের ছাঁটাইয়ের পেছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়, সেই ইলিয়া সাটসকেভারও এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়, তাদের দাবি পূরণ না হলে তারা একসঙ্গে পদত্যাগ করবেন এবং অল্টম্যানের নেতৃত্বাধীন মাইক্রোসফটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দলে যোগ দেবেন। অল্টম্যানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ওপেনএআইর কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে শুরু করেন, তারা ছাড়া ওপেনএআইর কোনো মূল্য নেই।
একই দিন ইলিয়া সাটসকেভার জানান, অল্টম্যানের ছাঁটাইয়ের পেছনে তার ভূমিকার কারণে তিনি অনুশোচনায় ভুগছেন এবং সবাইকে আবারও একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে তিনি যথাসম্ভব চেষ্টা করবেন।
'মাইক্রোসফটে যোগ দেবেন অল্টম্যান'
ওপেনএআইকে ঘিরে নাটকীয়তার পরবর্তী অধ্যায় শুরু করেন মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা। তিনি ২০ নভেম্বর এক্সে একটি পোস্ট দিয়ে জানান, অল্টম্যান ও ব্রকম্যানসহ তাদের অন্যান্য সহকর্মীরা মাইক্রোসফটে যোগ দিচ্ছেন। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে এমেট শিয়ারকে নিয়োগের কিছুক্ষণ পরই সত্য নাদেলা এই ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, 'আমরা এটা জানাতে পেরে খুবই আনন্দিত যে স্যাম অল্টম্যান ও গ্রেগ ব্রকম্যান মাইক্রোসফটে যোগ দিচ্ছেন। তাঁরা মাইক্রোসফটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত একটি আধুনিক গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেবেন। তাদের সাফল্যের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে দ্রুত সরবরাহ করা হবে।'
উল্লেখ্য, মাইক্রোসফটের সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কয়েকটি সেবার নেপথ্যে রয়েছে ওপেনএআইয়ের প্রযুক্তি। মাইক্রোসফটের বিং সার্চ ইঞ্জিন ও এজ ব্রাউজারেও ওপেনএআইয়ের উদ্ভাবিত চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা হয়েছে।
খুব অল্প সময়ে চ্যাটজিপিটির অভাবনীয় সাফল্যের কারণে অন্যান্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট তৈরিতে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। গুগল ইতোমধ্যেই 'বার্ড' নামে একটি চ্যাটবট চালু করেছে, যদিও জনপ্রিয়তার দিক থেকে এটি চ্যাটজিপিটির তুলনায় অনেকখানি পিছয়ে আছে।
ওপেনএআইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। তবে এখনো সে অর্থের খুব সামান্য অংশই বিতরণ করা হয়েছে।
নতুন পরিচালনা পর্ষদ ও অল্টম্যানের ঘরে ফেরা
ছাঁটাইয়ের পাঁচ দিনের মাথায় ২১ নভেম্বর ওপেনএআই জানায়, স্যাম অল্টম্যান প্রধান নির্বাহী হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটিতে ফিরছেন।
ওপেনএআইয়ের পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন পরিচালনা পর্ষদে আছেন তিনজন সদস্য। তারা হলেন, সেলসফোর্সের সাবেক সহকারী প্রধান নির্বাহী ব্রেট টেইলর, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী ল্যারি সামারস এবং কিউওরার প্রধান নির্বাহী অ্যাডাম ডি' অ্যাঞ্জেলো।
এদের মধ্যে অ্যাডাম ডি' অ্যাঞ্জেলো আগের পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য ছিলেন।
মাইক্রোসফটে যোগ দেওয়ার পরও আবারও ওপেনএআইতে ফেরার পেছনে সত্য নাদেলার সম্মতি আছে বলেও জানিয়েছেন অল্টম্যান। গ্রেগ ব্রকম্যানও ফিরছেন ওপেনএআইতে।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ইয়াহু, মিন্ট, টেক ক্রাঞ্চ, বিবিসি, ইন্ডিয়া টুডে
Comments