দেশভাগের ক্ষত যাকে ভুলিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট
সাত ম্যাচে ছয় হারের পর বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। টুর্নামেন্টের সমীকরণে না থাকায় বাকি দুই ম্যাচ অনেকটা নিয়মরক্ষার। টানা হারের বোঝায় বিধ্বস্ত বাংলাদেশ দলও এই বাস্তবতা বুঝে নিজেদের করেছে আরও খোলসবন্দি। দিল্লি এসে বৃহস্পতিবার ছিল দলের বিশ্রাম। টিম হোটেলে গিয়েও তাই লাভ হয়নি। কথা বলা দূরে থাক ক্রিকেটাররা ছবি তুলতেও আপত্তি জানাচ্ছেন। বিশ্রামের দিনে সাকিব আল হাসানদের আর ভোগান্তির কারণ না হয় অন্য দিকে নজর দেওয়া গেল।
দিল্লির তৃণমূলের ক্রিকেটের হালচালের খবর জানতে গিয়ে মিলল দ্রোণাচার্য ক্রিকেট একাডেমির নাম, খোঁজে পাওয়া গেল একজন বর্ষীয়ান ক্রিকেট কোচের। ভারতের রাজধানী শহরে আগামীর ক্রিকেটার তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এই একাডেমি। ফোন করে খোলা আছে জেনে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পেরিয়ে একাডেমির মাঠে যেতে স্বাগত জানালেন মাথায় পাগড়ি পরা প্রায় ৯০ ছুঁইছুঁই প্রৌঢ়, তিনিই গুরুচরণ সিং।
পড়ন্ত বিকেলে অন্তত ৬০ জন ক্রিকেটার ব্যাটে-বলে ব্যস্ত করে রেখেছিলেন মাঠ। ৮৮ পেরুনো গুরুচরণ দূর থেকে তাদেরই দেখছিলেন। খানিকক্ষণ বয়সভিত্তিক দলের অনুশীলন দেখার সময় আলাপ হয় সলিল মালহোত্রার সঙ্গে। মাঠের এক পাশের নেটে তিনিও ব্যাট করছিলেন। গত মৌসুমে দিল্লির রঞ্জি স্কোয়াডে ছিলেন সলিল। জানালেন, ৮ বছর বয়স থেকে এখন ২৫ বয়স পর্যন্ত এই একাডেমিই তার ঠিকানা। তার মতন আরও অনেকের আশ্রয়।
তবে সলিলরা নন, দ্রোণাচার্যের মূল আকর্ষণ কোচ গুরুচরণই। ৬০ বছর ধরে আছেন কোচিং পেশায়। পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় দুই পুরস্কার দ্রোণাচার্য আর পদ্মশ্রী। ১৯৮৬-৮৭ সালে ভারতের জাতীয় দলের কোচ ছিলেন তিনি, সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন কপিল দেব। কোচিং করিয়েছেন সুনিল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রি মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের মতো গ্রেটদের। তার কোচিংয়েই নিজেকে শাণিত করে জাতীয় দলে ঠাঁই পান কৃত্তি আজাদ, অজয় জাদেজা, মুরালি কার্তিকরা।
কবে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু আপনার? জিজ্ঞেস করতে ফিরে গেলেন অনেক পেছনে। যেখানে লেগে আছে রক্তের দাগ, জন্মভূমি ছেড়ে পালানোর ভয়াল স্মৃতি, 'আমার জন্ম রাওয়ালপিন্ডিতে, যেটা এখন পাকিস্তানে। ১২ বছর বয়েসে ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় পালিয়ে পাঞ্জাবে আসি। কিন্তু আমার বাবা আসতে পারেননি, তিনি নিহত হয়েছিলেন। আমার মা নিহত বাবাকে রেখে আমাদের নিয়ে আশ্রয় নেন পাঞ্জাবের পাতিয়ালায়।'
১৬ বছর আগে একবার রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মভূমি দেখতে গিয়েছিলেন। কিছুই আর আগের মত নেই জেনে চোখ ছলছল হয়ে উঠল। তবে সেখানেও যে ক্রিকেটাটা আছে তা বলতে উজ্জ্বল হলো মুখ। ছোটবেলায় তিনি ক্রিকেট শুরু করেছিলেন রাওয়ালপিন্ডিতেই। তবে পাঞ্জাবের ভারত অংশে এসে ক্রিকেটার হিসেবে হয়েছেন বিকশিত, '১৭ বছর আমি পাঞ্জাবের রঞ্জি দলে খেলেছি, পরে রঞ্জি খেলেছি রেলওয়েজের হয়েও।' সত্তরের দশকে ক্রিকেট ছাড়ার পর জড়িয়ে যান কোচিংয়ে। আজও আছেন এই পেশায়। বয়সের কারণে সরাসরি দীক্ষার কার্যক্রম কমেছে। তার ছেলে ও নাতি লেভেল টু কোচিং কোর্স সম্পন্ন করে হাল ধরেছেন একাডেমির। তবে সকাল থেকে রাত অবধি এই বয়সেও সব দেখভাল করেন গুরুচরণ, 'যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে, ততক্ষণ ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকব। ক্রিকেট ছাড়া আমি আর কোন কাজই পারি না। ক্রিকেটই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।' দেশভাগের সময় দাঙ্গায় পিতৃহীন হওয়ার পর কঠিন সময়ে গুরুচরণের বাঁচার রসদ হয়ে যায় ক্রিকেট, 'ক্রিকেট তখন আমার রক্ষাকবচ।'
এরপর পুরোটা জীবন জুড়ে ব্যাট-বলের সঙ্গে সম্পর্ক। নিজের পরিবারকেও টেনে এনেছেন ক্রিকেটে। তিনি যখন কথা বলছিলেন তার ছেলে, নাতি-নাতনিরাও ব্যস্ত ছিলেন একাডেমির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায়। একেকজন পালন করছেন একে দায়িত্ব।
দ্রোণাচার্য ক্রিকেট একাডেমির মাঠে আছে ছয়টি আলাদা উইকেট। এমনকি ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থাও আছে। রাতের আলোতেও থেমে থাকে না কার্যক্রম, 'রোজ মাঠে এসে আমি উইকেট নেড়েচেড়ে দেখি। এই এক আলাদা অনুভূতি।'
প্রথাগত কোচদের অনেকে ক্রিকেটের বদল নিয়ে অনেক সমালোচনা করেন। সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট নিয়ে থাকে একধরণের বিরক্তি। গুরুচরণের বেলায় দেখা গেল ব্যতিক্রম। তার মতে পরিবর্তনই তো স্বাভাবিক, 'সব কিছুই যুগে যুগে পরিবর্তিত হবে। ক্রিকেটও আলাদা কিছু নয়। এটাকে আমি খারাপ মনে করি না। দেখুন, সবই তো ক্রিকেট। বেসিক তো একই। আমি এখানে বেসিক শেখাতে চাই। যার বেসিক আছে সে যেকোনো ধরণের ক্রিকেট খেলতে পারবে।'
গুরুচরণের দ্রোণাচার্য ক্রিকেট একাডেমিতে ক্রিকেটের দীক্ষা নেন আড়াইশ খেলোয়াড়। আছেন নারী ক্রিকেটাররাও। বিভিন্ন ব্যাচে চলে কার্যক্রম। সপ্তাহে সবাই অন্তত একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। কখনো নিজেরা ভাগাভাগি করে কখনো বাইরের কোন দলের সঙ্গে গিয়ে ম্যাচ খেলেন তারা। দিল্লি ক্রিকেট ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। এখানকার ছেলে বীরান্দর শেবাগ, শেখর ধাওয়ানরা। এখানকার সবচেয়ে বড় নাম নিঃসন্দেহে বিরাট কোহলি। উঠতি তরুণদের সামনে বড় আইডল আর হাতের কাছে গুরুচরণের মতন প্রজ্ঞাবান কোচ, আছে দ্রোণাচার্য্যের মতন বেশ কয়েকটি একাডেমি, আছে ক্রিকেটের প্রতি তীব্র প্যাশন, দারুণ ব্যবস্থাপনা তো আছেই। বড় স্বপ্নে বিভোর হওয়ার সুযোগ এখানকার তরুণদের তাই অবারিত।
Comments