জিরুদ: পরীক্ষিত এক অবহেলার নাম
বলুনতো, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সর্বকালের সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক কে? আপনার মাথায় হয়তো অনেকগুলো নাম ঘুরপাক খাচ্ছে। খাবে নাই বা কেন, এই তালিকায় যে যুক্ত অনেক রথী-মহারথীর নাম। অলটাইম গ্রেট মিশেল প্লাতিনি থেকে শুরু করে এই লিস্টে আছে জিনেদিন জিদান, করিম বেনজেমা, থিয়েরি অঁরি, রিবেরি, এমবাপের মত অনেক বড় বড় নাম। কিন্তু এতসব গ্রেটদের টপকে এই রেকর্ড এখন কার জানেন? তার নাম অলিভিয়ে জিরুদ। পরিচিত লাগছে? এই বিশ্বকাপে ৪ গোল করার সুবাদে অনেকের কাছে এই নাম পরিচিত লাগলেও এর আগে এই নাম শোনেননি এরকম মানুষের সংখ্যাই বেশি। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা হতে পারে ফ্রেঞ্চ মিডিয়ার জিরুদ কে নিয়ে বেশিরভাগ সময় নিরুত্তাপ থাকা, অনেক স্পোর্টস মিডিয়ার মতে, এই যুগের সবচেয়ে কম আলোচিত স্ট্রাইকারের লিস্টেও প্রথমদিকেই আছে জিরুদের নাম।
পুরো নাম 'অলিভিয়ে জনাথন জিরুদ', ১৯৮৬তে ফ্রান্সের ফ্রজ গ্রামে জন্ম এই তারকার। নিকটস্থ 'গ্রেনোবেল' ক্লাবের মাধ্যমে ২০০৫ সালে তার প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু। ৯৮ এর বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিশ্বজয়ে অনুপ্রাণিত এই ফুটবলার প্রথম চোখ কাড়েন ২০১২তে যখন মন্টেপেলিয়ার তার নেতৃত্বে পিএসজিকে হারিয়ে লীগ শিরোপা ঘরে তোলে, জিরুদ লীগের টপ স্কোরার নির্বাচিত হন।
এরপর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। লীগে অনবদ্য পারফর্মের সুবাদে তারকাখচিত আর্সেনালের কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের চোখে পড়ে যান তিনি। ফলাফল একই বছর যুক্ত হন গানার শিবিরে। ২০১৮ তে আর্সেনাল ছাড়ার আগে ছয় বছরে ৭৩ গোল করে ক্লাবের টপ স্কোরার লিস্টেও জায়গা করে নেন এবং পরবর্তীতে চেলসিতে যোগ দেন। তিন বছর চেলসিতে পার করা সময়ে জিতেছেন ইউরোপা লীগ, চ্যাম্পিয়নস লীগের মত সবচেয়ে বড় বড় শিরোপা। চেলসি ছেড়ে গতবছর ইতালিতে পাড়ি দেন এবং মূল স্ট্রাইকার হিসেবে ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলানে যোগ দিয়ে ১০ বছর লীগ শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের হাতেখড়ি হয় জিরুদ ২০১১ তে মন্টেপেলিয়ারে থাকা অবস্থায়। জাতীয় কোচের নজরে থাকায় অ্যাটাকার হিসেবে ফ্রান্স জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। ১১ বছরের জাতীয় ক্যারিয়ারে ১১৮ ম্যাচে ৫৩ গোলের মাধ্যমে তিনি অঁরি, জিদান, বেনজেমাসহ সবাইকে পেছনে ফেলে ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক হন। প্রতি ম্যাচে দুইটি গোল করার সর্বোচ্চ রেকর্ডও (১০) তার অধিকারে।
জিরুদকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায়শই যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তা হলো তাকে নিয়ে মিডিয়ার অনাগ্রহ। সাদামাটা, চুপচাপ গোছের ব্যক্তিত্ব এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সোশ্যাল হ্যান্ডেলে তুলে না আনা হয়ত অনেকগুলো কারণের একটি। কিন্তু প্রধানত যে কারণে জিরুদ কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি তা হচ্ছে দলের বাকি ফরোয়ার্ডদের ছায়া হয়ে থেকে যাওয়া। তা সে জাতীয় দল হোক অথবা ক্লাব ফুটবল। মন্টেপেলিয়ারে তারকা বনে যাওয়া তরুণ ইউরোপের বিভিন্ন লীগে নিয়মিত পারফর্ম করলেও দুর্ভাগ্যবশত কখনোই মিডিয়ায় নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
আর্সেনালে পার করা ছয় বছরে ৩টি এফএ কাপ জিতেছেন, গোল অথবা অ্যাসিস্ট করেছেন ৩টি ফাইনালেই। লীগে নিয়মিত গোল করেও ছিলেন আর্সেনাল তারকা মেসুত ওজিলের ছায়ায়। ভাগ্য বদলাতে চেলসিতে পাড়ি দিয়ে থাকতে হয়েছে উঠতি তারকা আলভারো মোরাতার ছায়ায় এবং পিষ্ট হয়েছেন কোচ বদলের যাঁতাকলে। শুধু তাই নয়, ২০১৮/১৯ মৌসুমে ইউরোপা লীগের ফাইনালে নিজের আগের দল আর্সেনালের বিপক্ষে গোল ও অ্যাসিস্ট করেও ঢাকা পড়ে যান চেলসির অন্যতম সেরা পারফর্মার, বিদায়ী খেলোয়াড় ইডেন হ্যাজার্ডের শেষ ম্যাচের কারণে। চেলসি কোচ পরিবর্তন করে যখন টুখেলকে নিয়োগ দেয় জিরুদ তখন ভেবেছিলেন এবার তার ভাগ্য হয়তো বদলাবে কিন্তু টুখেল তাকে প্রাধান্য দেননি এবং তিনি থেকে গেছেন 'সুপার সাব' হিসেবেই। প্রিমিয়ার লীগ, চ্যাম্পিয়নস লীগের অনেক ম্যাচে শেষার্ধে সাবস্টিটিউট হিসেবে নেমে গোল করে দলকে বাঁচিয়েছেন কিন্তু কোচের নিছক খামখেয়ালীতে কখনোই নিজেকে মূল একাদশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।
ভাগ্যদেবী যে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তাও নয়। ২০১৫ পর্যন্ত সতীর্থ করিম বেনজেমার ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকলেও ২০১৬ এর ইউরোতে জাতীয় দলে ডাক পান। দুর্দান্ত খেলে জয় করে নেন ব্রোঞ্জ বুট বা ৩য় সর্বোচ্চ গোলস্কোরারের খেতাব। ইউরোতে চমকপ্রদ পারফর্মেন্সের কারণে মূল দলে নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেন জিরুদ। দেশের জার্সি গায়ে তার বেশিরভাগ গোলগুলো আসতে থাকে এরপর থেকেই। ফলাফলে ২০১৮ এর বিশ্বকাপ স্কোয়াডে মূল স্ট্রাইকার হিসেবেই বেছে নেওয়া হয় তাকে।
কিন্তু ওইযে! ভাগ্যদেবী সহায় ছিলেন না বোধহয়। বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ (৭) খেলেও ঝুলিতে ভরতে পারেননি একটি গোলও। তবে প্রয়োজনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে দলকে জেতাতে সহায়তা করেছেন বারবার। তার অ্যাসিস্টেই এমবাপের গোলে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে ৪-৩ গোলে আর্জেন্টিনার বাধা কাটায় ফ্রান্স। বিশ্বকাপে জিতলেও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তার পারফরম্যান্স।
ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে ৩৬ বছর বয়সে এসে আজ তাকে নিয়ে এতগুলো কথা বলার উপলক্ষ নিয়ে এসেছে কাতার ওয়ার্ল্ডকাপ ২০২২। যদিও চলমান বিশ্বকাপ দলে স্কোয়াডে ছিলেন কিন্তু মূল দলে তার খেলা ছিল অনিশ্চিত। করিম বেনজেমা ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে মূলদলে খেলার সুযোগ আসে জিরুদের সামনে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই বাজিমাত করেছেন জিরুদ। প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জোড়া গোলের পাশাপাশি গোল করেছেন রাউন্ড অব সিক্সটিন এবং কোয়ার্টার ফাইনালেও। ৪ গোল দিয়ে গোল্ডেন বুটের দৌড়েও ভালোই এগিয়ে আছেন যেখানে তার প্রতিপক্ষ মূলত সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপে (৫) এবং মহাতারকা লিওনেল মেসি(৪)। কেউ কেউ কালেভদ্রে প্রশংসা করছেন কিন্তু বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুটের দৌড়ে প্রবলভাবে আলোচিত সেই মেসি এবং এমবাপেই। সেভাবে কেউই বলছেন না অলিভিয়ে জিরুদের কথা। এসব নিয়ে হয়তো খুব একটা ভাবছেন না ফরাসি এই স্ট্রাইকার।
আর দুই ম্যাচে সেরা পারফর্ম করতে পারলে শেষ বিশ্বকাপ খেলতে আসা এই স্ট্রাইকার হয়তো গোলসংখ্যাকে নিয়ে যেতে পারেন আরও উঁচুতে, জায়গা করে নিতে পারেন অলটাইম গ্রেটদের কাতারে। জিরুদ কি পারবেন তাকে তুচ্ছ করে আসা সেই গোষ্ঠীকে সঠিক উত্তর দিতে নাকে ইতিহাসে বরাবরের মতই থাকবেন শিরোনামহীন? উত্তরটা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র পাঁচটি দিন!
Comments