স্পেনকে ছিটকে দিয়ে মরক্কোর ইতিহাস
শক্তির বিচারে পিছিয়ে থাকলেও মরক্কোর মাঠের খেলায় পাওয়া গেলো না সেই ছাপটুকুও। কাউন্টার অ্যাটাকে বেশ কয়েকবার সুযোগ তৈরি করল তারা, কিন্তু ফিনিশিং ব্যর্থতায় পেল না কাঙ্খিত গোলের দেখা। স্পেনও নষ্ট করল একাধিক সুযোগ। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ গড়ায় টাই-ব্রেকারে। অবিশ্বাস্য লাগলেও সেখানে একটি শটও জালে জড়াতে পারেনি স্পেন! ইয়াসিন বুনোর অসাধারণ নৈপুণ্যে লুইস এনরিকের শিষ্যদের হারিয়ে প্রথমবারের কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিল মরক্কো।
মঙ্গলবার দোহার এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে টাই-ব্রেকারে স্পেনকে ৩-০ ব্যবধানে হারায় মরক্কো। নির্ধারিত সময়ের খেলা গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়েও হয়নি কোনো গোল।
গোটা ম্যাচে যেন সুযোগ হাতছাড়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছিল স্পেন-মরক্কো। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়েও গোলের একাধিক সুযোগ নষ্ট করে দুই দল। ফলে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টিতে। তাতে চমকে দেয় আফ্রিকানরা, স্পেনের জালে তারা তিনবার বল জড়ালেও হজম করেনি একটি গোলও। তাতেই সৃষ্টি হলো ইতিহাস, প্রথমবারের মতো শেষ আটে জায়গা করে নিলো মরক্কো। চতুর্থ আফ্রিকান দেশ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল দলটি।
ম্যাচের শুরু থেকেই নিজেদের উজাড় করে দিয়ে খেলতে থাকে ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের শিষ্যরা। অন্যদিকে বল পায়ে রেখে সুযোগ বুঝে আক্রমণে যেতে থাকে স্পেন। চতুর্থ মিনিটে পেদ্রির পাস কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন তারই বার্সেলোনা সতীর্থ গাভি। সুযোগ ধরা দেয় মরক্কোর হাতেও, ১২ মিনিটে পাওয়া ফ্রি কিক কাজে লাগাতে পারেনি তারা।
২২ মিনিটে বাঁ প্রান্তে দারুণ পায়ের কাজ দেখান সোফিয়ান বোফাল। মার্কোস ইয়োরেন্তেকে পরাস্ত করে উইং দিয়ে বল টেনে যোগান দেন নিঁখুত এক ক্রস। ইউসেফ এন-নেসিরি সেটা ঠেলে দেন হাকিম জিয়েশকে। শট নেওয়ার উপযুক্ত অবস্থানে থেকেও গড়মসি করে বল হারান চেলসি তারকা।
তিন মিনিট বাদে মারাত্মক ভুল করে বসেন মরক্কো গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনো। দৌড়ে এসে তার দুর্বল পাস ধরে ফেলেন ফেরান তোরেস। অযথা কালক্ষেপণ না করে বল দেন দানি অলমোকে। আরবি লাইপজিগ তারকার শট বুনো পুরোপুরি ফেরাতে পারেননি, ত্রাতারূপে আবির্ভূত হয় গোলবার। তখনই অফসাইডের বাঁশি বাজান রেফারি, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মরক্কো।
২৬ মিনিটে জর্দি আলবার দারুণ এক থ্রু পাস থেকে মার্কো অ্যাসেনসিওর সামনে সুযোগ ধরা দিলেও রিয়াল তারকা শট নেন বাইরে। ৩০ মিনিটে এন-নেসিরিকে রোমান সাইসের বাড়ানো বলের কাছে ভিড়তে দেননি রদ্রি। ৩৩ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট নেন নৌসাইর মাজরাউই। সেটা রুখে দিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন উনাই সিমন।
৪২ মিনিটে আরও একবার সুযোগ হারান আফ্রিকানরা। হাকিমের ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে সার্জিও বুসকেতস বল দিয়ে দেন বোফালকে। তার পাল্টা ক্রস থেকে নায়েফ আগুয়ের্ড হেড করেন গোলবারের বাইরে দিয়ে। একাধিক সুযোগ হাতছাড়ার মাশুল দিয়ে গোলশূণ্য স্কোরলাইন নিয়ে বিরতিতে যায় দুই দল।
দ্বিতীয়ার্ধেও একের পর এক আক্রমণ শানাতে ব্যস্ত থাকে স্পেন-মরক্কো। ৫৫ মিনিটে দানি আলমো নেন দারুণ এক শট। তবে তা থেকে কোন বিপদ ঘটতে দেননি বুনো। ৮১ মিনিটে তাকে একা পেয়েও শট না নিয়ে ক্রস করেন আলভারো মোরাতা। ৮৬ মিনিটে ডানপ্রান্তে গতির ঝলক দেখিয়ে ক্রস করেন হাকিমি, তবে ওয়ালিদ চেদিরা তার শটে দিতে পারেননি জোর।
দুই মিনিটের মাথায় আবারও স্প্যানিশ বক্সে ত্রাস ছড়ায় মরক্কো। কিন্তু এবারও কাঙ্খিত সাফল্য ধরা দেয়নি তাদের হাতে। পরের মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাকে উঠে এনরিকের শিষ্যরাও, আলভারো মোরাতার পাস থেকে শট নেন বদলী নিকো উইলিয়ামস। রোমান সাইসের কল্যাণে গোল হজমের হাত থেকে রক্ষা পায় মরক্কো।
৯০ মিনিটের পর যোগ করা সময়ে ফ্রি কিক পায় স্পেন। তবে কার্লোস সোলারের ক্রস থেকে মোরাতে ক্রসবারের ওপর হেড করলে মাঠে মারা যায় সেই সুযোগ। পাঁচ মিনিট বাদে অল্পের জন্য রক্ষা পায় মরক্কো, অলমোর ফ্রি কিক বাঁক নিয়ে গোলপোস্টে ঢুকে যাওয়ার মুখে ফেরান বুনো।
১০০ মিনিটে মোরাতার ক্রস কাজে লাগাতে পারেননি তার কোন সতীর্থ। একই মিনিটে অ্যালেক্স বালদের শটও রুখে দেয় মরক্কো রক্ষণ। চার মিনিটে বাদে এগিয়ে যেতে পারত মরক্কো, আজজেদিন ওনাহির দারুণ পাস ধরে দ্রুত বক্সে ঢুকে শট নেন চেদিরা। পা দিয়ে গোল রুখে স্প্যানিশদের স্বপ্ন ঠিকিয়ে রাখেন সিমন।
১১৫ মিনিটে আবারও সুযোগ নষ্ট করেন চেদিরা, গতির জোরে সবাইকে পরাস্ত করে স্প্যানিশ ডি বক্সে ঢুকে পড়লেও শট চালাতে ব্যর্থ হন ২৪ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। তিন মিনিট বাদে পাল্টা আক্রমণে যায় স্পেনও। এবার গতির ঝড়ব তুলেন উইলিয়ামস। রাইট উইং থেকে তার করা ক্রস থেকে কোন বিপদ ঘটতে দেননি হাকিমি।
অতিরিক্ত সময়ের শেষভাগে দুর্ভাগ্যে পতিত হয় এনরিকের শিষ্যরা, পাবলো সারাবিয়ার শট বারপোস্টে লাগলে হতাশায় পুড়ে স্পেন। ফলে খেলা গড়ায় পেনাল্টিতে। মরক্কোর হয়ে প্রথম শটে গোল করেন আবদেলহামিদ সাবেরি। স্পেনের হয়ে প্রথম শট নিতে এসে ব্যর্থ হন সারাবিয়া। গোলবার ফিরিয়ে দেয় তার চেষ্টা।
দ্বিতীয় পেনাল্টিতে মরক্কোর পক্ষে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন জিয়েশ। তবে সোলারের শট বুনো রুখে দিলে আবারও হতাশায় পুড়ে স্পেন। মরক্কোর পক্ষে তৃতীয় পেনাল্টিতে বাদর বানুনে গোল করলেই জিতে যেন আফ্রিকানরা। কিন্তু এবার সঠিক দিকে ঝাঁপিয়ে তার চেষ্টা রুখে দেন সিমন। স্পেনের হয়ে তৃতীয় পেনাল্টি নিতে এসে হতাশ করেন অধিনায়ক বুসকেতসও।
চতুর্থ শটে আর কোন ভুল হয়নি মরক্কোর, আশরাফ হাকিমির ঠান্ডা মাথার কিকে উল্লাসে মাতে আতলাসের সিংহরা। কান্নায় ভেঙে পরেন স্প্যানিশ ফুটবলাররা। ইতিহাস গড়ে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট কেটে নেয় মরক্কো।
Comments