কাতারের দোহা থেকে

বিশ্বকাপের মাঠে রাজনীতি!

World Cup Football Fan
ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে গ্যালারিতে এক দর্শক

বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে সমর্থকরা কি শুধু প্রিয় দলের সমর্থনেই ছুটে আসেন? সহজ কথায় এর উত্তর 'না'। বিশ্বকাপের মাঠে অনেকেই আসেন নিজেদের রাজনৈতিক দাবি নিয়ে, অনেকেই নিজেদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নেন ফুটবল বিশ্বকাপকে। কাতার বিশ্বকাপও ফুটবল মাঠের এই রাজনীতির বাইরে নয়। এখানে শুধু সমর্থকরাই না, খেলোয়াড়রাও নিজেদের রাজনৈতিক মত প্রকাশ করছেন মাঠে এসে।

কাল নেদারল্যান্ড আর কাতারের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম দোহা থেকে একটু দূরে আল খোরের আল বায়েত স্টেডিয়ামে। এই ম্যাচে নেদারল্যান্ডের চেয়ে কাতারের সমর্থকই মাঠে উপস্থিত ছিল বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশ থেকে আসা সমর্থকরাই কাল কাতারকে সমর্থন দিয়েছেন। যদিও আগেই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া কাতার এই ম্যাচও হেরে আসর শেষ করেছে একেবারে খালি হাতে। তবে তা নিয়ে কাতারিদের মধ্যে কোনো আফসোস নেই।

World Cup Football Fan

পশ্চিমা দেশগুলোর নানা সমালোচনা পেছনে ফেলে একটি সফল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারছে, এতেই তারা খুশি। কিছু বিষয় বাদ দিলে, বিশ্বকাপ নিয়ে কাতার যে বিশাল আয়োজন করেছে, বিশ্বকাপ দেখতে আসা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের জন্য মাঠ ও মাঠের বাইরে যেসব সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, সেই হিসেবে এই বিশ্বকাপ এখনো পর্যন্ত সফলই বলা যায়। শুধুমাত্র মদ্যপানের বিষয়টি বাদ দিলে পশ্চিমা আর লাতিন সমর্থকরাও কাতার বিশ্বকাপের প্রশংসা করছেন।

World Cup Football Fan

কাতার বিশ্বকাপ দেখতে এসে মাঠে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি আমার চোখে পড়ছে সেটি হচ্ছে ফিলিস্তিনের পতাকা। ফিলিস্তিন তো বিশ্বকাপে খেলছে না, তাহলে মাঠে ফিলিস্তিনের পতাকা কেন? এমন কৌতূহল অনেকেরই থাকতে পারে। শুরু থেকে আমারও ছিল। কাল সেই কৌতূহল মেটানোর সুযোগ পাওয়া গেল। আল বায়েত স্টেডিয়ামে কাতার আর নেদারল্যান্ডসের খেলা চলাকালীন সময়ে আমার পাশে আসন পড়েছিল ফিলিস্তিনি মেয়ে লিয়ানা আর তার মায়ের। বিশাল এক ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে সে মাঠে এসেছে। গালে এঁকে নিয়ে এসেছে ফিলিস্তিনের পতাকা। আমি জানতে চাইলাম বিশ্বকাপের মাঠে সে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে কেন এসেছে?

World Cup Football Fan

লিয়ানা আমাকে জানালো- 'আমাদের ভূখণ্ড অবৈধ দখলদার ইসরায়েলিদের হাত থেকে ফেরত পাওয়ার দাবি জানাচ্ছি!'  লিয়ানা আমার কাছে জানতে চাইলো, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি। আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ নামটা শুনেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে জানালো ফিলিস্তিনিরা বাংলাদেশকে খুব ভালোভাবেই চিনে। ওদের নানা দুঃসময়ে যেসব দেশ সবসময় ফিলিস্তিনের পাশে থাকে বাংলাদেশ তাদের একটি। বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের অনেক ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করতে যায় এটাও তার অজানা নয়। তারপর আড্ডায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন লিয়ানার মা। তিনি আমাকে জানালেন, লিয়ানার জন্ম কাতারে। এমনকি তার নিজের জন্মও কাতারে। এই দেশ ফিলিস্তিনিদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়ের নাম। খেলার ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকা আড্ডায় লিয়ানা আমাকে জানালো- 'ইসরায়েলিরা দখল করতে করতে আমাদের পুরোটা দেশ গিলে ফেলেছে। এখন যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকু খেয়ে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরায়েদির এই দখলবাজি দেখে না, আমাদের প্রিয়জনদের উপর চালানো নিপীড়ন  দেখেও না দেখার ভান করে। তাই আমরা ফিলিস্তিনিরা এই বিশ্বকাপকে বেছে নিয়েছি আমাদের অধিকার আর ভূখণ্ড ফেরত চাওয়ার দাবির মাধ্যম হিসেবে। যতটা ম্যাচে আমরা ফিলিস্তিনিরা মাঠে যাচ্ছি সেখানেই আমরা ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে মাঠে যাচ্ছি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের  দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাইছি- আমাদের দেশ দখলদার মুক্ত করে আমাদেরকে ফেরত দাও!'

যে মেয়ের জন্মই হয় নাই নিজের দেশে, এমনকি তার মায়ের জন্মও নিজ ভূখণ্ডের বাইরে সেই মেয়ের দেশপ্রেম দেখে অভিভূত না হয়ে পারিনি। এমন করে নিজের দেশকে কতজনইবা পারে ভালবাসতে?

World Cup Football Fan

বিশ্বকাপ মাঠের এই রাজনীতিতে শুধু ফিলিস্তিনিরাই নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন না। বিশ্বকাপ মাঠের এই রাজনীতিতে নানা ইস্যু নিয়ে মাঠে নিজেদের দাবি তুলে অবস্থান জানান দিচ্ছেন অন্যান্য দেশের সমর্থকরাও। ইরানের সমর্থকদের অনেকেই মাঠে নিয়ে আসছেন হিজাব না পরায় পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু হওয়া মাশা আমিনির ছবি। নানা ধরনের ব্যানার আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। দেশটিতে নারী মুক্তির দাবি উঠছে জোরেশোরে। পর্তুগাল-উরুগুয়ে ম্যাচে যেমন এক দর্শক ইরানের নারীদের আন্দোলনের সমর্থন লেখা টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে মাঠে ঢুকে পড়েন!

World Cup Football Fan
গ্যালারিতে দেখা মিলে মাশা আমিনির। ছবি: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম

ইরানের খেলোয়াড়রাই বা বাদ যাবেন কেন। দেশের মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে জাতীয় সঙ্গীতের সময় ইরানের খেলোয়াড়রা কণ্ঠ মেলাননি। অন্যদিকে জার্মানির পুরো দল মুখে হাত দিয়ে ছবি তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছে কাতার বিশ্বকাপের নানা ধরনের বিধিনিষেধের!

কাতার আর নেদারল্যান্ডের খেলা শেষ করে ছুটে গিয়েছি ফ্যান ফেস্টে। সেখানে গিয়ে দেখি ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচ নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা আবহ। বিশ্ব রাজনীতির কারণেই সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ম্যাচটা। সেখানে প্রথম দিকে আক্রমণাত্মক মানসিকতায় খেলা শুরু করলেও পরে রক্ষণাত্মক খেলা শুরু করে নিজেদের অর্ধে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয় ইরান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই ম্যাচ জিতে চলে গেছে পরবর্তী রাউন্ডে। অনেক আশা জাগিয়ে প্রথম রাউন্ডেই বিশ্বকাপ শেষ ইরানের। ফ্যান ফেস্টে অনেককেই বলতে শুনলাম, নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ মাঠে জাতীয় সঙ্গীতের সময় গলা না মেলানোর জন্য ইরানি ফুটবলারদেরকে অনেক চাপ দেওয়া হয়েছে। কট্টোর ধর্মীয় বিধিনিষেধের দেশ ইরানে ফিরে তারা কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে পারেন। এই চাপেই নাকি ইরানের খেলোয়াড়রা ভেঙ্গে পড়েছেন আর সেই সুযোগে ম্যাচটা জিতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র!

World Cup Football Fan
উরুগুয়ে-পর্তুগাল ম্যাচে রঙধনু পতাকা আর ইরানের নারী আন্দোলনের সমর্থনে পরা টি-শার্ট পরে মাঠে ঢুকে পড়েন এক দর্শক। ছবি: টুইটার

কাতার বিশ্বকাপে খেলোয়াড় আর সমর্থকদের রাজনীতির কথা তো শুনলেন। এবার শোনা যাক বিশ্বকাপ নিয়ে কাতার রাষ্ট্রের রাজনীতির কথা। কাতার এই বিশ্বকাপকে নিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের এক মাধ্যম হিসেবে। এমনিতে কয়েকবছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ একসঙ্গে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল কাতারের বিরুদ্ধে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই নিষেধাজ্ঞার কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছে কাতার। আর এখন বিশ্বকাপের সময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্যদের বিশ্বকাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে কাতার সেই সম্পর্ককে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।  

ফুটবল বিশ্বকাপের মাঠে এই যে রাজনীতি এটা অন্য খেলাতে আর খুব একটা দেখা যায় না। ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সময়ে আমাদের দেশে অনেককেই বলতে শোনা যায়- 'খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না!' অথচ এখানে এসে দেখলাম বিশ্বকাপের মাঠকেই অনেকে নিজেদের রাজনৈতিক দাবি আদায়ের, সেই দাবির পক্ষে বৈশ্বিক সমর্থন পাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম মনে করছেন। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূখণ্ড ফেরত পাওয়ার জন্য বিশ্বকাপের মাঠে মাঠে ঘুরছেন নিজেদের দেশের পতাকা নিয়ে। চেনা নেই, জানা নেই এমন মানুষকে বলছেন তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকতে।

ফ্যান ফেস্ট থেকে খেলা শেষ হতে মধ্যরাত হয়ে যায়। মধ্যরাতে হোটেলে ফেরার সময় বিশ্বকাপের মাঠে বিশ্ব রাজনীতির এই মারপ্যাঁচ নিয়ে চিন্তা করতে করতে ফিলিস্তিনের মেয়ে লিয়ানার একটা কথাই কানে ভাসছিলো- 'আমরা আমাদের দেশটা ফেরত চাই, আমাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তুমি আমাদের পাশে থেকো।' গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাতের আলো ঝলমলে দোহার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বললাম- 'অবশ্যই তোমাদের পাশে থাকবো লিয়ানা, পৃথিবীর সব মুক্তিকামী মানুষের পাশেই আমি আছি...।' 

লেখক: দ্য ডেইলি স্টারের পাঠক 

Comments

The Daily Star  | English

A rush to heal exposed banking wounds

In October, a video on social media showed the manager of Social Islami Bank’s Agargaon branch breaking down in tears after enduring harsh verbal abuse from frustrated customers seeking to withdraw cash.

4h ago