১৯ বছর পর ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে কেন এই পতন?

আইসিসির বার্ষিক র্যাঙ্কিংয়ের হালনাগাদ টোকা দিয়ে জানান দিল বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে বাংলাদেশ কতটা ধসে পড়েছে। প্রায় দুই দশক পর আইসিসির ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ নেমে গেল দশে।
৫০ ওভারের ক্রিকেট একটা সময় যে জাতির কাছে ছিলো গর্বের জায়গা, সেখানে হলো বেদনাদায়ক পশ্চাদপসরণ। সাম্প্রতিক এই পতনকে খুব অপ্রত্যাশিত বলা যায় না, বরং তা একটি বৃহত্তর সমস্যাকে তুলে ধরে যা বহু বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটে দানা বাঁধছে। কেবল খালি কয়েকটি ওয়ানডে ম্যাচ হেরে যাওয়ার ব্যাপার নয়। এটা দীর্ঘদিনের একটা প্রতিচ্ছবি, যা থেকে উত্তরণের আভাস দেখা যাচ্ছে না।
নতুন র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ দল চারটি রেটিং পয়েন্ট হারিয়েছে। ৭৬ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন দশে, ৮৩ পয়েন্ট নিয়ে নয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আফগানিস্তানের অবস্থান সাতে। ২০০৬ সালে সর্বশেষ ওয়ানডেতে দশে ছিলো বাংলাদেশ, পরের বছর উত্তরণের পর উপরের দিকেই এগিয়েছিলো দল। আজ মনে হচ্ছে বাংলাদেশ যেন স্থবিরতার এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। যেখানে এক পা এগুলে পিছিয়ে যায় আরেক পা।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই পতনের সরাসরি কারণ বিগত এক বছরের ওয়ানডে পারফরম্যান্স। ২০২৩ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জেতার অর ২৪ ওয়ানডে খেলে জিতেছে কেবল ছয়টি। আইসিসি টুর্নামেন্ট এবং দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তাদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স প্রমাণ করে যে দলটি তাদের একসময়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে কতটা দূরে সরে গেছে।
তারা যে ছয়টি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেছে, তারমধ্যে জিতেছে মাত্র একটি (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে জয়)। বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অভিযান ছিল তো বিপর্যয়কর। হারের সঙ্গে হারের ধরনও ছিলো পীড়াদায়ক।
তবে এই পতন উদ্বেগজনক হলেও, এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সংকটের মূল কারণ নয়। আসল সমস্যা আরও গভীরে – দেশের ক্রিকেটের একেবারে ভিত্তিমূলে: ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল)।
অধিকাংশ ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে ঘরোয়া কাঠামো আন্তর্জাতিক সাফল্যের ভিত্তি তৈরি করে। বাংলাদেশের জন্য ডিপিএল একসময় সেই ভিত্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল। এক সময় যেখানে তরুণ প্রতিভার লালন-পালন হতো, যেখানে ক্রিকেটাররা প্রথমবার প্রতিযোগিতামূলক লিস্ট-এ ক্রিকেটের স্বাদ পেত এবং যেখানে দেশের ভবিষ্যতের তারকারা তৈরি হতো।
১৯৮০ থেকে ২০০০-এর দশকের শুরুতে ডিপিএল ছিল শ্রেষ্ঠত্বের আঁতুড়ঘর এবং এটি বাংলাদেশের সেরা কিছু খেলোয়াড় তৈরি করেছে। তবে আজ, ডিপিএল প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত । একসময়ের গৌরবময় লীগ এখন একটি জরাজীর্ণ প্রাসাদের মতো – তার আগের চেহারার একটি অন্তঃসারশূন্য কাঠামো।
প্রতিযোগিতা ঘিরে উৎসাহ উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং ক্রিকেটের মান উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় শুধু খেলার মান নয়, খেলোয়াড়রা এখন যে সামান্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন তাও।
গত বছরের তুলনায় এবার পারিশ্রমিক প্রায় অর্ধেক কমে যায়, অনেক ক্রিকেটারকে মাত্র ৫০,০০০ টাকার মতো নামমাত্র পারিশ্রমিকে খেলতে বাধ্য করা হচ্ছে – যা তাদের মৌলিক খরচও মেটাতে যথেষ্ট নয়।
এই পতনের কারণ অনেক। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উত্থান, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রমবর্ধমান উদাসীনতা – এই সবই ভূমিকা রেখেছে।
তবে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হলো বিষাক্ত ক্লাব রাজনীতি যা লীগটিকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে। ক্রিকেটের মূল ফোকাস সরে গিয়েছে বোর্ডরুমের কৌশল এবং রাজনৈতিক লাভের দিকে। যা একসময় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লীগ ছিল, তা এখন অনুমেয় এবং বস্তাপচা হয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের হতাশ ও নিষ্পৃহ করে তুলেছে। ডিপিএলের এই পতন সরাসরি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত।
একসময়, ডিপিএল ছিল খেলোয়াড়দের নিজেদের প্রমাণ করার, নির্বাচকদের প্রতিভা চিহ্নিত করার এবং দেশের একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরির প্রধান প্ল্যাটফর্ম।
এখন লড়াইয়ের ঝাঁজহীন ম্যাচের সংখ্যাই বেশি। এছাড়া আর্থিক প্রণোদনা কমে যাওয়ার কারণে, ক্রিকেটারদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার মতো কিছুই নেই। উদ্বেগজনকভাবে, এমনকি নির্বাচকরাও প্রতিভা অনুসন্ধানের জন্য ডিপিএল ম্যাচগুলো মাঠে গিয়ে দেখতে আগ্রহ বোধ করছেন না।
সর্বশেষ র্যাঙ্কিং একটি সতর্ক ঘণ্টা: বাংলাদেশ ক্রিকেট আর এই কাঠামোগত ব্যর্থতা উপেক্ষা করতে পারে না। বিসিবি যদি ডিপিএলকে অবহেলা করা অব্যাহত রাখে, তবে জাতীয় দল কেবল আরও অপ্রাসঙ্গিকতার দিকে ধাবিত হবে।
আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে টাইগারদের পতনের সঙ্গে প্রশ্নটি আর কেবল এই নয় যে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা। যে ভিত্তি একসময় তাদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিলো তার সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে পারবে কিনা সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তা না হলে পতন অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটের একসময়ের গর্বিত ভিত্তি ভেঙে পড়তেই থাকবে।
Comments