নতুন প্রত্যয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রত্যাবর্তন

দীর্ঘ নিদ্রায় হারিয়ে যাওয়া এক মহাকাব্যের স্পন্দন ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি নিয়ে, আবারও ক্রিকেটের মঞ্চ কাঁপাতে ফিরে আসছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

১৯৯৮ সালে 'আইসিসি নকআউট ট্রফি' নামে জন্ম, এরপর ২০০২ সালে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ—এই টুর্নামেন্ট ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিয়েছে বহু স্মরণীয় মুহূর্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ও একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা, ২০০৪ সালে পাকিস্তানের প্রথমবারের মতো আইসিসি ইভেন্টে ভারতের বিপক্ষে জয়, কিংবা ২০০৬ সালে ক্যারিবিয়ান লেজের ব্যাটারদের ইংল্যান্ডের হাত থেকে নাটকীয়ভাবে ম্যাচ ছিনিয়ে নেওয়া—সবকিছুই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসের অংশ।

একসময় দুই বছর অন্তর আয়োজিত হলেও, ২০০৯ সালের পর থেকে চার বছরের ব্যবধানে আয়োজন শুরু হয় এই আসর, যেখানে আইসিসি ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ আট দল অংশ নেয়। কিন্তু ২০১৭ সালের পর আট বছর পেরিয়ে গেছে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি যেন এক বিস্মৃত অতীত, ওয়ানডে ক্রিকেটের পরিচয়ে এক শূন্যস্থান।

২০২৫ সালে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই আবারও ফিরে আসছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। কিন্তু এখন ক্রিকেট বদলে গেছে—টি-টোয়েন্টি লিগগুলো দখল করেছে ক্যালেন্ডার, টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, আর ওয়ানডে যেন এক অনিশ্চিত অবস্থানে ঝুলে আছে—না পুরোপুরি গুরুত্বপূর্ণ, না একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো।

এটা শুধুই একটি ফেরা নয়, এটি এক যুদ্ধের ডাক। আইসিসি এখানে ঘিরে রেখেছে দৃষ্টি, দিয়েছে বিশাল আর্থিক প্রণোদনা—৬.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেকর্ড পুরস্কার তহবিল, যা আগের আসরের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি। এমনকি গ্রুপ পর্বের প্রতিটি জয়ের জন্য ৩৪ হাজার ডলারের বেশি পুরস্কার নির্ধারিত হয়েছে, যা প্রতিটি ম্যাচকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—আট বছর পর ফিরে আসা এই টুর্নামেন্ট কি ওয়ানডে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে? একসময় একমাত্র বিশ্বকাপকেই প্রধান ইভেন্ট ধরে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল, কিন্তু এর প্রত্যাবর্তন ইঙ্গিত দেয়—ওয়ানডে এখনও বেঁচে আছে। তবে কতদিন?

দর্শকদের কমে যাওয়া মনোযোগের যুগে ৫০ ওভারের ক্রিকেট লড়াই করছে টিকে থাকার জন্য। টি-টোয়েন্টির ধ্রুব উত্তেজনা কিংবা টেস্ট ক্রিকেটের সূক্ষ্ম কৌশলের মাঝে ওয়ানডে মাঝের ওভারগুলোতে গতি হারিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ, যা একসময় আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের মূল অংশ ছিল, সেগুলোও এখন টি-টোয়েন্টি লিগ ও গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট সিরিজের কাছে জায়গা হারাচ্ছে।

এই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাফল্য হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটকে নতুন প্রাণ দিতে পারে; আবার ব্যর্থতা হতে পারে এর আরও পতনের সূচনা। আর এর মঞ্চ কোথায়? পাকিস্তান। এমন এক দেশ, যেখানে ক্রিকেট রক্তের স্রোতে প্রবাহিত হয়, অথচ ১৯৯৬ সালের পর সেখানে আর কোনো আইসিসি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। এবার করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোর প্রস্তুত ক্রিকেটের মহাযজ্ঞের জন্য।

এবারের ফরম্যাটও নির্মম—দুই গ্রুপে চারটি দল। কোনো সহজ ম্যাচ নেই, ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কেবল সেরা দলগুলোরই সামনে এগোনোর সুযোগ থাকবে। একটিমাত্র ভুল, আর পুরো যাত্রা শেষ।

উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড—একটি লড়াই, যা গোটা টুর্নামেন্টের গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় উপকাহিনী? সেটা ভারত-কেন্দ্রিক। অবিরাম রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে তাদের ম্যাচগুলো দুবাইয়ে আয়োজন করতে হচ্ছে। এটি এক ধরনের আপস, যা ক্রিকেটের সাথে ভূরাজনীতির সম্পর্ক স্বরণ করিয়ে দেয়।

প্রথম থেকেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নতুনত্বের সূতিকাগার। একসময় এটিকে 'মিনি বিশ্বকাপ' বলা হতো, যার প্রথম আসর হয়েছিল বাংলাদেশে, তখনও পূর্ণ সদস্যপদ পায়নি দেশটি। দ্বিতীয় আসর বসেছিল কেনিয়ায়।

২০০২ সালে এই টুর্নামেন্ট পেল নতুন রূপ, বদলে গেল ফরম্যাট, প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হলো ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (ডিআরএস)। এবারও আসছে প্রযুক্তির ছোঁয়া—চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহৃত হবে, যা ভক্তদের জন্য ব্যক্তিগতকৃত রিক্যাপ এবং আরও ইন্টারঅ্যাকটিভ অভিজ্ঞতা দেবে।

দলগুলোর জন্য এবার পরিষ্কার লক্ষ্য—ভারত ও অস্ট্রেলিয়া, বর্তমান শীর্ষ দুটি ওয়ানডে দল, আসবে বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি নিয়ে। পাকিস্তান, নিজেদের মাটিতে খেলবে, সমর্থকদের আবেগকে শক্তিতে পরিণত করার প্রত্যয়ে। ইংল্যান্ড, সাম্প্রতিক ব্যর্থতা ভুলে প্রমাণ করতে চাইবে যে তারা এখনও সাদা বলের ক্রিকেটে শাসন করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের রয়েছে নিজস্ব উচ্চাশা, আর বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান জানে—এমন টুর্নামেন্টে এক মুহূর্তের মোমেন্টাম পুরো দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে।

বিশ্ব ক্রিকেটের দৃষ্টি এখন পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কেবল আরেকটি টুর্নামেন্ট নয়, এটা এক পরীক্ষাসময়।

তবে আপাতত, প্রতীক্ষা তুঙ্গে—যেন ঝড়ের আগে প্রথম বজ্রপাত। এই আসর কি ৫০ ওভারের ক্রিকেটকে নতুন জীবন দেবে, নাকি এটা হবে আরও এক বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি? উত্তর দেবে সময়।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

8h ago