১২ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ভিডিওবার্তায় তামিম যা বললেন

গতকাল মঙ্গলবার রাতে দেওয়া হয় বাংলাদেশের ১৫ জনের বিশ্বকাপ স্কোয়াড। অনেক নাটকীয়তার পর সেখানে রাখা হয়নি তামিম ইকবালকে। নির্বাচকরা পরে জানান, তামিমের ফিটনেস ঘাটতি থাকায় ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এসেছে এই সিদ্ধান্ত। এরপর বুধবার সকালে নিজের ফেসবুক পেজে তামিম জানান, ভিডিওবার্তা দিতে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশ দল বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে রওয়ানা হওয়ার পর গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরবেন।

বিকাল পাঁচটার একটু পর তামিমের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি ভিডিওবার্তা পোস্ট করা হয়। সেখানে তামিম যা যা বলেছেন, তা নিচে দেওয়া হলো দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য।

'স্লামালেকুম সবাইকে।

প্রথমেই বলে নিই যে গলায় ইনফেকশন হয়েছে, সো পরিষ্কারভাবে হয়তো বলতে পারছি না।

আজকে মূলত কথা বলার কারণটা, আপনারা (ফেসবুক) স্ট্যাটাস দেখেই বুঝতে পেরেছেন যে গত দুই-তিন দিনে যা যা হচ্ছে, যা যা লেখা হয়েছে বিভিন্ন গনমাধ্যমে আর আসলে যা ঘটেছে— সম্পূর্ণ আলাদা। যে জিনিসটা ঘটেছে, পুরো জিনিসটাই ধাপে ধাপে জানাই। কারণ আমার মনে হয় যে এই জিনিসটা আমার ভক্ত এবং যারা ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশের, তাদের জানা উচিত।

মূলত আপনারা সবাই জানেন, আমি অবসরে নিই, অবসর নেওয়ারও একটা কারণ ছিল। অবসর থেকে আমি আবার প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে ফিরে আসি। তারপর যে দুই মাস ছিল, আমার মনে হয়, আমি প্রচণ্ড পরিমাণে কষ্ট করি নিজেকে ফিট করার জন্য। আমি নিশ্চিত, যারা যারা সম্পৃক্ত ছিল এটাতে, ফিজিও-ট্রেনার সবাই একমত হবেন যে এরকম কোনো সেশন নাই বা এরকম কোনো এক্সারসাইজ নাই যা উনারা আমার কাছে চেয়েছেন (কিন্তু) আমি করি নাই নিজেকে ফিট করার জন্য।

অবশ্যই, যখন খেলা শুরু হলো, (খেলার সময়) কাছাকাছি আসলো, তখন মানসিক দিক থেকে আমি খুব বেশি খুশি ছিলাম না। এটা কেন? কারণ গত চার-পাঁচ মাসে যা যা ঘটেছে... যদি নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, আপনারা বুঝতে পারবেন যে এটা আসলে খুব একটা সহজ জিনিস না।

তবে যখন আমি খেলা শুরু করলাম, প্রথম ম্যাচে আমি ৩০-৩৫ ওভারের মতো ফিল্ডিং করলাম, ব্যাটিং করতে পারলাম না দুর্ভাগ্যক্রমে। দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ আসলো। আমার জন্য সম্ভাব্য সেরা যে ফলটা দরকার ছিল, ওটা হয়েছে (রান পেয়েছি)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ম্যাচটা হেরে যাই। আমি সব সময় বলি, রানের মূল্য নেই, যদি আপনি না জেতেন।

তবে ওই মুহূর্তে আমার জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার ছিল (তা হলো) কিছুটা রান করা এবং ব্যাটিংটা কেমন হচ্ছে অনুভব করা। যেভাবে ব্যাটিং করেছি, তাতে অনেক খুশি ছিলাম। আমি মাত্র ৪৪ রান করেছি, তবে আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, ভালো খেলছিলাম বড় কিছু করার জন্য। তবে সেটি হয়নি দুর্ভাগ্যক্রমে। সেই ম্যাচের পর আমি মানসিক দিক দিয়ে খুব খুশি ছিলাম। সবশেষ ৪-৫ মাস যা হয়েছে, সেগুলো (আর) মাথায় অতটা ছিল না। আমি খেলার জন্য মুখিয়ে ছিলাম, বিশ্বকাপের জন্য মুখিয়ে ছিলাম।

এত দিন পর যখন আপনি ক্রিকেট খেলবেন, আপনি চোট থেকে সেরে উঠেছেন, স্বাভাবিকভাবে ব্যথা-অস্বস্তি আপনার শরীরে থাকবেই। আমারও তাই হয়েছে। প্রথম ম্যাচের পরও ব্যথা অনুভব করেছি। পরের ম্যাচেও হয়েছে। যখন খেলা শেষ হলো, আমি আমার অবস্থানটা ফিজিওকে বললাম যে আমি এমন বোধ করছি। ঠিক ওই মুহূর্তে তিনজন নির্বাচক ড্রেসিংরুমে আসেন। একটা জিনিস একদম পরিষ্কার করতে চাই, আমি কোনো সময়, কোনো মুহূর্তে, কাউকেই বলি নাই যে আমি (বিশ্বকাপে) পাঁচটা ম্যাচের বেশি খেলতে পারব না। আমি নিশ্চিত, গতকাল নান্নু ভাইও এই কথাটা পরিষ্কার করেছে। এটা একটা মিথ্যা কথা, ভুল কথা। আমি জানি না এটা গণমাধ্যমকে কীভাবে গেলানো হয়েছে বা কে করেছে। এই জিনিসটা একেবারেই মিথ্যা। যেটা নির্বাচকদের আমি বলেছিলাম যে আমার শরীরটা (এখন) এরকমই থাকবে, যে অবস্থায় আছে (তাতে) ব্যথা থাকবে। তো আপনারা দল যখন নির্বাচন করবেন, এটা মাথায় রেখে করবেন। এটারও একটা কারণ আছে।

কারণ আপনারা যদি কিছুদিন আগের কথা চিন্তা করেন, যখন আমি অধিনায়ক ছিলাম, যে ম্যাচের পর অবসর নেই, ওখানে আমার চোট নিয়ে একটা শঙ্কা ছিল। ফিজিও, কোচ আর আমি মিলে বসে কথা বলেছিলাম। তিনজন সহমতও হয়েছিলাম যে (আফগানিস্তানের বিপক্ষে) প্রথম ম্যাচে আমার খেলা উচিত। এরপর আপনারা জানেন যে কেমন ধরনের কথা গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, যদি ফিট না থাকি, তাহলে খেলা উচিত না। ওই সময় খুব অবাক লেগেছে কারণ ওই রুমে সবাই সহমত হয়েছিলাম।

(এবার) আমি আরেকটি বিতর্ক তৈরি করতে চাইনি। পুরোপুরি সৎ থেকে আমার তরফ থেকে নির্বাচকদের বলেছি, আপনারা জিনিসটা মাথায় রেখে আমাকে নির্বাচন করেন। কারণ হলো, যদি আমি বিশ্বকাপে যাই, এমন হতে পারে নয় ম্যাচ খেলি সমস্যা ছাড়া। বিশ্বকাপের সূচি এমন ছিল, প্রতি ম্যাচের পরই তিন-চার দিনের বিরতি আছে, প্রথম দুটি ম্যাচ ছাড়া। আবার এমনও হতে পারে, যে কোনো সুস্থ মানুষের সঙ্গেও হতে পারে, দুটি ম্যাচ খেলার পর চোট হয়ে গেল, এরপর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, তার বদলি খেলোয়াড় নেওয়া হলো। বদলি খেলোয়াড় তো আপনি নিতেই পারেন, যদি কেউ চোট পায়। এ কারণে আমি এই জিনিসটা পরিষ্কার করে তাদেরকে বলি।

বলার পর যখন আমরা হোটেলে যাই, আমাকে পর্যবেক্ষণ করে, আমার ব্যথা ছিল। পরের দিনও পর্যবেক্ষণ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা, ফিজিওর রিপোর্টে কী ছিল? অনেকেই কালকে জিজ্ঞেস করছিল। যথাযথভাবে যে কথাটা ছিল, আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করতে চায়, তাদেরকে স্বাগত জানাই। আমার সঙ্গে যে কোনো পাবলিক ফোরামে বসেন, আমাকে বলেন যে আমি ভুল বলেছি।

ফিজিওর রিপোর্টে যেটা ছিল, আমার কন্ডিশনটা বলা হয়েছিল। প্রথম ম্যাচের পর এমন ব্যথা হয়েছিল, দ্বিতীয় ম্যাচের পর এমন ব্যথা হয়েছে। আর আজকের দিন (সেদিনের) হিসাবে (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) ২৬ সেপ্টেম্বরের ম্যাচের জন্য সে অ্যাভাইলেবল। কিন্তু মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট মনে করে, যদি আমি বিশ্রাম নিই ২৬ তারিখ, কারণ ২৭ তারিখ আমাদের ভ্রমণ ছিল (ভারতের উদ্দেশে), ২৮ তারিখ (মূলত ২৯ তারিখ) আমাদের একটা প্রস্তুতি ম্যাচ, তারপর (অক্টোবরের) ১-২ তারিখে আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচ। আমি যদি এখন বিশ্রাম নিই, আমি যদি দ্বিতীয় প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলি, তাহলে পর্যাপ্ত সময় পাব। এতে এই দুই সপ্তাহের রিহ্যাব হয়ে যাবে, সব মিলিয়ে ১০ সপ্তাহের রিহ্যাব হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রথম ম্যাচটা খেলার জন্য আমি খুব ভালো অবস্থায় থাকব। রিপোর্টে একদম এটাই ছিল।

কোনো জায়গায় কোনো সময় বলা হয়নি যে পাঁচ ম্যাচ-দুই ম্যাচ, চোট, খেলতে পারব না এতকিছু। হ্যাঁ, আমার শরীরে ব্যথা ছিল যেটা অস্বীকার করছি না। সংবাদ সম্মেলনেও বলেছি। মূলত এটাই হয়েছে। তারপর যে জিনিসটা হয়, গণমাধ্যমে যেটা আসছে চোট, পাঁচ ম্যাচ (খেলব)... আমার কাছে মনে হয় না বিশ্বকাপে (আমার) না যাওয়ার পেছনে এটার বড় অবদান ছিল। কারণ আমি যেহেতু চোটগ্রস্ত হইনি এখনো, ব্যথা থাকতে পারে কিন্তু চোটগ্রস্ত হইনি এখনও।

তার এক-দুইদিন পর আমাকে বোর্ডের উচ্চ পর্যায় থেকে একজন ফোন করলেন। উনি বেশ সম্পৃক্ত আমাদের ক্রিকেটের সঙ্গে। আমাকে হঠাৎ করে ফোন করে বললেন, তুমি তো বিশ্বকাপে যাবা, তোমাকে তো মানিয়ে নিয়ে খেলাতে হবে। তুমি এক কাজ করো, তুমি প্রথম ম্যাচ খেলো না, আফগানিস্তানের সঙ্গে। আমি বললাম, ভাই, এটা এখনও ১২-১৩ দিন পরের কথা। আমি তো এর মধ্যে ভালো অবস্থায় থাকব (শারীরিকভাবে)। কী কারণে খেলব না? তখন বললেন, আচ্ছা, তুমি যদি খেলোও, আমরা এমন একটা পরিকল্পনা করছি বা আলোচনা করছি, তোমাকে আমরা নিচে ব্যাটিং করাব।

ভাই, একটা জিনিস আপনাদের মনে রাখতে হবে যে আমি কোন মাইন্ডসেট থেকে আসছিলাম। হঠাৎ করে একটা ভালো ইনিংস খেলেছি, আমি খুশি ছিলাম। হঠাৎ করে এসব ধরনের কথা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। আমি ১৭ বছর ধরে এক পজিশনে ব্যাটিং করেছি। জীবনে কোনো দিন তিন-চারে ব্যাটিংই করিনি। এমন যদি হতো যে আমি তিনে ব্যাটিং করি, চারে ব্যাটিং করি, তারপর যদি (ব্যাটিং পজিশন) ওপর-নিচ করা হয়, সেটা মানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু আমার তিনে, চারে বা পাঁচে ব্যাটিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি (তার) কথাটা ভালোভাবে নিইনি। উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ বিষয়টা আমার পছন্দ হয়নি। কারণ মনে হচ্ছিল, আমাকে জোর করে অনেক জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। এটা (চোট) ঠিক হলো, এখন আরেকটা জিনিস করি। এটাই আমার মনে হয়েছিল।

তখন আমি বললাম যে দেখেন, আপনারা একটা কাজ করেন, যদি আপনাদের এমন চিন্তাধারা থাকে, তাহলে আপনারা আমাকে (বিশ্বকাপে) না পাঠান। আমি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চাই না। প্রতিদিন আপনারা আমাকে একেকটা নতুন জিনিসের মুখোমুখি করাবেন, আমি এই জিনিসগুলোয় থাকতে চাই না। তারপরও ফোনে ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমার অনেক কথাবার্তা হয়। আমার মনে হয় না যে এই প্ল্যাটফর্মে বলা উচিত। এটা আমার আর উনার মধ্যেই থাক। তারপর আমি শক্তভাবে বলেছি যে এরকম যদি হয়, আমি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চাই না। আপনারা দরকার হলে আমাকে (দলের জন্য) বাছাই না করেন।

সর্বোপরি আমি ব্যক্তিগতভাবে যে জিনিসটা অনুভব করেছি, খবরগুলো গণমাধ্যমকে গেলানো হয়েছে, আমি জানি না যে আমি ঠিক বলছি কি বলছি না। কারণ আমাদের অনেকেরই অভ্যাস আছে, বড় একটা জিনিসকে ঢাকার জন্য আরেকটা জিনিস গেলানো যে সে পাঁচ ম্যাচ খেলবে, তাকে কীভাবে বাছাই করব। এরকম কোনো ধরনের কোনো কথা হয়নি।

আমি নিশ্চিত সেদিন নির্বাচকরা ছিল, ফিজিও ছিল, ট্রেনার ছিল— সবাই ছিল। আমি কী বলেছি, সেটা আপনাদের সঙ্গেও পরিষ্কার করেছি। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হয়, যদি সত্যিই আপনারা আমাকে (দলে) চান, আমাকে মানসিকভাবে নির্ভার ও খুশি করা উচিত। কারণ আমি গত তিন-চার মাস খুব বাজে সময় কাটিয়েছি। আমার জন্য খুব কঠিন ছিল তিন-চার মাস। তো (আমাকে) একেকটা নতুন নতুন জিনিস বলা... সঙ্গে আমি এটাও বলি, আমাকে হয়তো এই কথাকেই যদি আমাকে ভিন্নভাবে বলা হতো, তাহলে হয়তো আমি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাতাম, হয়তো বিষয়টি মেনে নিতাম। কিন্তু হঠাৎ করে কেউ যদি কোনো কারণ ছাড়া আপনাকে ফোন করে বলে, আপনি না খেলেন বা বলে যে আচ্ছা যদি খেলেনও, আমাদের এরকম আলোচনা হচ্ছে যে নিচে ব্যাটিং করাবে, আমি নিশ্চিত না যে এটা কতটুক ন্যায্য। এটাই আসলে ঘটেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই। আমি এতটুকুই বলব, আমি আমার তরফ থেকে যতটুকু অনুভব করেছি, আমার সঙ্গে যেটা ঘটেছে, ওগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।

সবশেষে যে ১৫ জন বিশ্বকাপে গিয়েছে, তাদেরকে শুভ কামনা জানাচ্ছি। আমি আশা করি, তারা যতটুকু সম্ভব, বাংলাদেশের জন্য সাফল্য নিয়ে আসবে। আরও অনেক কিছুই ঘটছে, এটা আপনারা দেখছেন। একটা কাহিনী বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে, দুইটা কাহিনী ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তবে একজনের সঙ্গে গত তিন-চার মাসে যদি সাত-আটটা কাহিনী হয়, তাহলে সেটা ইচ্ছাকৃত হয়। আমি এটা অনুভব করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার আর বলার নাই।

আপনারা ভালো থাকবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আর একটা অনুরোধ করব সবাইকে, আমাকে মনে রাখবেন সবাই। ভুলে যাবেন না।'

Comments

The Daily Star  | English

$14b a year lost to capital flight during AL years

Bangladesh has lost around $14 billion a year on average to capital flight during the Awami League’s 15-year tenure, according to the draft report of the committee preparing a white paper on the economy.

14h ago