ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তুঘলকি কাণ্ড বন্ধ করুন
বাংলা অভিধানে কাণ্ডজ্ঞান বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ—বুদ্ধিবিবেচনা বা অবস্থাভেদে বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা। শহরের ব্যস্ততম জনপরিসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান চলাচলে অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা তৈরি করে কাণ্ডজ্ঞানহীন এক স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তৈরি হচ্ছে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা।
মাত্র কয়েক মাস আগে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর থেকে 'একনায়ক' শেখ হাসিনাকে উৎখাতের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই ক্যাম্পাসে চলাচলে এমন বিধি-নিষেধ নিশ্চিতভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ভীষণ বিরক্তিকর। এমন অজনপ্রিয়, অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?
বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিতভাবেই এক ধরনের বিশেষ এলাকা। শহর থেকে একটু দূরে, কোলাহলমুক্ত পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পূর্ব শর্ত। বিশ্বের বেশিরভাগ প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলামেলা, সবুজ আচ্ছাদিত কম জনসমাগমের এলাকা হয়ে থাকে। এটা নিশ্চিতভাবেই বড় মানদণ্ড। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে অন্য ক্যাম্পাসের সঙ্গে মেলাতে যাওয়া নিতান্তই বোকামি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান চর্চা ও সৃজন কেন্দ্রই নয়, এটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতিবাদী লেখক আহমদ ছফা যাকে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আগ্নেয়আত্মার জ্বালামুখ হিসেবে। দেশে যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের তীর্থকেন্দ্র এই ক্যাম্পাস। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)। এ ছাড়া এই ক্যাম্পাস চত্বরে আছে বাংলা একাডেমী, ব্রিটিশ কাউন্সিল, শহীদ মিনারের জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সেখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিতভাবেই মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। একইসঙ্গে ঢাকা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও এই ক্যাম্পাসের ভেতরে। আছে অন্তত তিনটি পাবলিক স্কুল। পলাশী বাজার, বুয়েট ও নিউমার্কেটের কথা না হয় উল্লেখ না-ই করলাম।
১৪ ডিসেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন ও অন্যান্য কর্মদিবসে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। শুক্র ও শনিবার এবং কোনো ছুটির দিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এ ছাড়া অন্যান্য কর্মদিবসে ক্যাম্পাসের ভেতরে বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত যান চলাচল সীমিত থাকবে। উপাচার্যের এই তুঘলকি সিদ্ধান্তে এরইমধ্যে ওই এলাকার মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত। অসন্তোষ ও ক্ষোভ জানাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। কিন্তু সেটা কারও কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুহম্মদ বিন তুঘলক নামের এক শাসক ছিলেন। তুঘলক বংশের এই শাসক ইতিহাসে 'পাগলাটে রাজা' হিসেবে পরিচিত। দিল্লির এই শাসক তার ২৫ বছরের শাসনামলে এতসব উদ্ভট কর্মকাণ্ড করেছেন যে ইতিহাসবিদরা তার কার্যকলাপকে তুঘলকি কাণ্ড বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তুঘলক নিজে বিদ্বান, বুদ্ধিমান, সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন। কিন্তু তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ছিল অবাস্তব ও আবেগী। এ ছাড়া তিনি নিজের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে প্রজাদের ওপর অন্যায় চাপ প্রয়োগ করতেন। নিপীড়ন করতেন নিজ রাজ্য ও অন্য রাজ্যে বসবাসকারীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিশ্চিতভাবেই জ্ঞানী। তাদের বিচার ও বিবেচনা জ্ঞান নিশ্চিতভাবেই প্রখর। কিন্তু তারপরও কেন এমন অবাস্তব সিদ্ধান্ত? সেই সিদ্ধান্তকে নগরবাসীর অনেকেইে আখ্যায়িত করছেন তুঘলকি কাণ্ড বলে, যা মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ। হাসিনা সরকারের নিবর্তনমূলক আইনে কারাগারে মৃত্যুবরণ করা লেখক মুশতাকের কথা মনে আছে? ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরের হাইসিকিউরিটি কারাগারে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। তখন আমরা গুরুদুয়ারার বিপরীতে রোকেয়া হলের এক্সটেনশন শিক্ষক কোয়ার্টারে থাকতাম। ওই বাসার অষ্টমতলা থেকে রাজু ভাস্কর্য চত্বর সরাসরি দেখা যায়।
স্পষ্ট মনে আছে, ওই রাতে হাতেগোনা কয়েকজন নাগরিক রাজু ভাস্কর্যের সামনে মুশতাক হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। স্বৈরাচার হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছিলেন। আগামীতে যদি এ রকম গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, আর তাতে যদি কেউ প্রতিবাদ জানাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হতে চায়, তখন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের অনুমতি লাগবে? ক্যাম্পাসের দ্বার রক্ষকরা কি ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীদের আটকে দেবে? দায়িত্বরত শিক্ষার্থীরা কি অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন?
সব কিছু চিন্তা করে মনে হয়, আমরা কি ধীরে ধীরে সেই অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্বপরায়ণ কাঠামোর দিকেই আবার যাত্রা শুরু করেছি? চলমান বিধি-নিষেধ তুলে নিন। তবে হ্যাঁ, ক্যাম্পাসে মাইক ব্যবহার বন্ধসহ গাড়ির হর্ন নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, যা খুবই জরুরি।
আমার ক্যাম্পাসে তুঘলকি কাণ্ড বন্ধ হোক, আজই।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Comments