হাতি-মানুষের ‘অনিবার্য’ সংঘাত নিরসনে করণীয়
বাংলাদেশে যে প্রজাতির হাতি দেখা যায় তা এশিয়ান এলিফ্যান্ট বা এশীয় হাতি নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বনাঞ্চলে হাতি অনেকটাই সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। একের পর এক নিধনের শিকার হচ্ছে বিপন্ন এই প্রাণী। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তরাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে বন্য এশীয় হাতির আবাসস্থলগুলোর যে জায়গাগুলোতে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে ও কৃষির সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে।
হাতির আবাসে মানুষের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও কৃষির এই সম্প্রসারণের ফলে স্থলভাগের সবচেয়ে বড় তৃণভোজী এই প্রাণীটির বিচরণের জায়গা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি তা বিভক্তও হয়ে পড়ছে। ফলে মানুষের সঙ্গে বন্য হাতির সংঘাতের বিষয়টি হয়ে উঠেছে অনিবার্য।
একটি হাতি দিনে ১৫০ কেজি ঘাস, ১০০ কেজি কলা গাছ, ৫ কেজি কলা ও ২৮ কেজি সবজি খায়। পানি পান করে ১৯০ লিটার। এ কারণে খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বড় একটা পরিসরজুড়ে ঘুরে বেড়াতে হয় হাতিকে। এজন্য এরা অনেকটা বাধ্য হয়েই মানুষের বসতি এলাকায় ঢুকে পড়ে।
বাংলাদেশে হাতিগুলো ঐতিহ্যগতভাবে নির্দিষ্ট যাতায়াত পথ অনুসরণ করে। কিন্তু প্রকৃতিবিনাশী ও অপরিণামদর্শী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এই পথগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা হচ্ছে। যখন হাতিরা স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে না, তখন এরা গ্রাম বা মানুষের বসতি এলাকায় চলে আসে। হাতি চলাচলের করিডোরের মধ্যে সড়ক, রেলপথ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ তাদের প্রাকৃতিক চলাচলকে ব্যাহত করে এবং হাতি-যানবাহন সংঘর্ষের পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়ায়।
জলবায়ু এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত গাছপালা ও জলসম্পদের পরিবর্তনের কারণে হাতিরা আরও বেশি করে মানববসতিতে আসতে বাধ্য হয়। কারণ খাদ্য ও পানির অভাব। যেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় হাতি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামক সেখানে দেহাংশ চোরাচালানের জন্য হাতি শিকারের পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক হত্যা, বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মৃত্যু, যানবাহনের ধাক্কা ও খাদ্যাভাবের মতো বিষয়গুলো এই প্রাণীটিকে দিনকে দিন সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন'র ২০১৭ সালের গবেষণা অনুসারে, সে সময় দেশের বনাঞ্চলগুলোতে মোট হাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হাতি ৬৭টি, মাদী হাতি ১৭২টি এবং বাচ্চা হাতি ২৯টি। অথচ ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচশর মতো হাতি ছিল।
ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছিল বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হাতির বিচরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের চুনতি, টেকনাফ, ফাসিয়াখালি, পাবলাখালি অভয়ারণ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বাঁকখালী রেজু, ফুলছড়ি, ঈদগড় ও মরিচ্চ্যা এলাকার বনাঞ্চলগুলোতে। ওই ২৬৮টি হাতির মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন হাতি ছিল ৮২টি। চিড়িয়াখানায় ছিল তিনটি। ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু ও গাজীপুর সাফারিপার্কে ছিল ১১টি হাতি। এছাড়া শেরপুর এলাকায় অভিবাসী হাতি ছিল প্রায় ৮০টি। এগুলোর ভেতর গত তিন বছরে ৫৩টি হাতি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
আর সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য বলছে, এখন সারাদেশে হাতির সংখ্যা কমে ১৩৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে হাতির বর্তমান সংকট নিরসনে কাজ করছে বন বিভাগসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) ও আইইউসিএন।
এখন হাতি-মানুষের অনিবার্য সংঘাত কমিয়ে আনতে হাতি চলাচলের জন্য 'সুরক্ষিত করিডোর' তৈরি করা যেতে পারে, যা হাতিদের নিরাপদে এক বনাঞ্চল থেকে অন্য বনাঞ্চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে হাতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যাপারে সচেতন করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে এমন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করে স্থানীয় সবার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বলা আছে, 'কোনো ব্যক্তি হাতি বা বাঘ দ্বারা আক্রান্ত হইলে এবং উহার ফলে তাহার জীবনাশঙ্কার সৃষ্টি হইলে জীবন রক্ষার্থে উক্ত আক্রমণকারি বাঘ বা হাতিকে হত্যা করতে পারবে।'
এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন। হাতি হত্যা করা যাবে না।
সেইসঙ্গে আইনের অন্য ধারাগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় আরও বিনিয়োগ হাতি-মানবের সংঘাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে জরুরি।
সর্বোপরি হাতির বিচরণক্ষেত্র নিরাপদ করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রাণীকল্যাণ কমিশন গঠন এবং বন বিভাগের অর্গানোগ্রাম সংশোধন করাও প্রয়োজন।
মো. আশিকুর রহমান: প্রাণি চিকিৎসক ও প্রাণিসেবা ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবী
Comments