বাংলার জ্যোতি: দুর্ঘটনা না হত্যাকাণ্ড?

প্রথমেই রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট বা ঝুঁকির মূল্যায়ন করতে হবে।
সম্প্রতি ‘বাংলার জ্যোতি’ জাহাজে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে বাঁধা অবস্থায় 'বাংলার জ্যোতি' জাহাজে একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যাতে নিহত হন জাহাজের একজন ক্যাডেটসহ ওয়ার্কশপের তিনজন কর্মী। 'বাংলার জ্যোতি' ও 'বাংলার সৌরভ' বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দুটি তেলবাহী ট্যাংকার। এর একটিতে আমিও এক সময় ক্যাডেট হিসেবে চাকরি করেছি। বাংলার জ্যোতি জাহাজে এবারেই প্রথম নয়, এর আগেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একটি তেলবাহী ট্যাংকার হলো সমুদ্রে ভাসমান সবচেয়ে বিপজ্জনক জাহাজ। এসব জাহাজে কীভাবে আগুন লাগে কিংবা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, তা সংক্ষিপ্ত এবং সহজবোধ্য ভাষায় বোঝাবার চেষ্টা করছি।

ঢাকা শহরে আমাদের চোখের সামনে প্রচুর বাসে দেখা যাবে, তাদের কোথাও কোথাও ধাক্কা খেয়ে স্টিল বাম্পার ভেঙে গেছে, মরিচা পরে বডির এক অংশ ক্ষয়ে গেছে, পেছনের সিঁড়ি ভেঙে গেছে, ইত্যাদি। এসব বাসের বডি ইস্পাতের তৈরি। এদের মেরামতের উপায়কে বলা হয় ওয়েল্ডিং। অর্থাৎ যে অংশ ভেঙে গেছে, তা কেটে নতুন একটি টুকরো লাগিয়ে দেওয়া।

একটি জাহাজও ইস্পাতের তৈরি। বাসের মতো পাতলা পাতের নয়, পুরু স্টিলের পাত, স্টিলের এঙ্গেল, রড, পাইপ দিয়ে জাহাজ তৈরি করা হয়। নোনা পানিতে চলাচলের কারণে মরিচা ধরে দ্রুত এবং এতে অনেক সময় বিভিন্ন অংশ একদম ক্ষয় হয়ে যায়, তাই মাঝেমধ্যেই মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। বাসের একটি পাত কিংবা পাইপ ডিস্ক কাটার কিংবা হ্যাকস ব্লেড দিয়েও কেটে ফেলা যায়, রিভেট দিয়ে আরেকটি পাত লাগিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু জাহাজের পুরু লোহা কাটার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্যাস কাটিংয়ের প্রয়োজন পড়ে এবং নতুন জোড়া দেওয়ার একমাত্র উপায় ওয়েল্ডিং।

এসব কাটিং ও ওয়েল্ডিংকে বলা হয় হট-ওয়ার্ক। হট-ওয়ার্ক বলতে এমন কোনো কাজ বুঝায় যেখান থেকে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি ডিস্ক কাটার দিয়ে কাটার সময় আতশবাজির মতো বেড়িয়ে আসা ফুলকি সৃষ্টি হলেও তাকে হট-ওয়ার্ক হিসেবে গণ্য করা হবে। জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হরহামেশা এসব হট-ওয়ার্কের প্রয়োজন পড়ে, আর জাহাজের অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে দায়ী হট-ওয়ার্ক। এজন্য জাহাজে হট-ওয়ার্ক করার আগে প্রচুর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

প্রথমত চেষ্টা করা হয় যে অংশটি মেরামত করতে হবে তা খোলা বা ডিস-ম্যান্টল করা যায় কি না। যেমন: ডেকের একটি পাইপে একটা ফুটা হয়ে গেছে। পাইপটির ওজন হয়তো ১০০ কেজি। তারপরেও সেটা খুলে নিয়ে আসা হবে ইঞ্জিনরুম ওয়ার্কশপে এবং সেখানে সেটা ওয়েল্ডিং করে আগের জায়গায় নিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হবে।

কিন্তু অধিকাংশই ক্ষেত্রেই খুলে ইঞ্জিনরুমে নেওয়া যায় না। হয়তো ক্রেন কিংবা মাস্তুলের কোথাও ক্ষয়ে গেছে, জাহাজের রেলিং ভেঙে গেছে কিংবা ডেকের এক অংশে ফুটা হয়ে গেছে। এগুলো জাহাজে স্থায়ীভাবে ওয়েল্ডিং করে লাগানোর জন্য তা খুলে আনা সম্ভব না। তখন জায়গায় বসেই কাজটা করা হয়। হয়তো আগেই ওয়ার্কশপে মাপ মতো স্টিলের টুকরা কেটে নেওয়া হয়, ভেঙে যাওয়া অংশটি গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে নতুন টুকরা বসিয়ে ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়। আপাত দৃষ্টিতে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার, এসব কাজ অহরহ আমরা রাস্তা ঘাটে, ওয়েল্ডিংয়ের দোকানে করতে দেখি। কিন্তু জাহাজে বিষয়টা এত সহজ না। এজন্য প্রচুর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়।

কাজ শুরু করার আগেই প্রচুর প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। আধুনিক হাসপাতালে একজন রোগীর অপারেশন করার আগে যে পরিমাণ প্রসিডিউর অনুসরণ করা হয়, জাহাজে হট-ওয়ার্ক করার আগে তারচেয়েও বেশি পরিমাণ প্রস্তুতি নেওয়া হয়। নিচে প্রস্তুতিপর্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলো।

ডিটেইল রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট

প্রথমেই রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট বা ঝুঁকির মূল্যায়ন করা হবে। কাজ করার সময় সম্ভাব্য কী কী ঝুঁকি থাকতে পারে, তার মাত্রা অনুযায়ী তালিকা করা হবে। জাহাজ শিল্পে অতীতে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং তাদের সম্ভাব্য কারণ অনুযায়ী ঝুঁকির তালিকা করা হয়। সেই তালিকার পাশাপাশি ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য কী প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে, তা লিখা হয়। যেমন: মাস্তুলের ওপরে ওয়েল্ডিং করতে হবে, সুতরাং সেখান থেকে মানুষ পরে আহত বা নিহত হতে পারে। সুতরাং সেখানে কাজ করতে হলে প্রয়োজন বোধে স্টেজিং করতে হবে, যে কাজ করবে তাকে বেঁধে রাখার সেফটি বেল্ট থাকবে। জাহাজ দুললে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, অতএব আবহাওয়া ভালো থাকলেই করা হবে অথবা জাহাজের কোর্স এমনভাবে সেট করতে হবে যাতে জাহাজ সবচেয়ে স্থিতিশীল থাকে।

ট্যাংকের ভেতরে কাজ হলে ধোঁয়া জমে যেতে পারে। অতএব ভেন্টিলেশন ফ্যান লাগাতে হবে। ট্যাংকের ভেতরে কেউ অসুস্থ হলে তাকে উপরে ওঠানো সহজ না। তাই আগে থেকে উপরে ওঠানোর কপিকল লাগিয়ে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যাতে অক্সিজেন দেওয়া যায়, সেজন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার উপরে রাখতে হবে। এমন প্রত্যেকটি ঝুঁকির জন্য কয়েকটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ থাকতে পারে। এসব মৌখিক নয়, সব লিখিত।

রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করার পর যদি দেখা যায় সব রিস্ক প্রতিরোধ করার মতো যথাযোগ্য এবং পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, তাহলেই কাজের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। যদি সম্ভব না হয়, কাজ শুরু করা হবে না, প্রয়োজনে জাহাজ ডকে নেওয়া হবে মেরামতের জন্য।

রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করার পর তা অফিসে পাঠাতে হবে। সঙ্গে পাঠাতে হবে ওয়ার্ক-প্ল্যান, অর্থাৎ কীভাবে কাজটা হবে তার বর্ণনা। প্রয়োজনবোধে ছবি ডায়াগ্রামসহ কাজের প্রস্তুতি এবং পদ্ধতি বিস্তারিত পাঠাতে হবে। অফিসে মেরিন সুপার ও টেকনিক্যাল সুপার এসব পরীক্ষা করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরীক্ষা করার পর জাহাজে ফোন করে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলবে পরিষ্কার বুঝে নেওয়ার জন্য। এরপর অফিস থেকে অনুমতি দেওয়া হবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।

হট-ওয়ার্ক চেক লিস্ট

হট-ওয়ার্ক চেক লিস্টে অনেক আইটেম রয়েছে কাজের প্রস্তুতির জন্য, তা একটা একটা করে চেক করতে হবে। হট-ওয়ার্ক যেখানে হবে, তার চারপাশে ফায়ার এক্সটিংগুইশার প্রস্তুত থাকবে। ফায়ার হোস প্রস্তুত থাকবে। শুধু তাই নয়, ফায়ার হোস সবসময় চার্জ অবস্থায় থাকতে হবে, মানে পানির পাম্প সর্বক্ষণ চলতে থাকবে, যাতে ফায়ার হোস পাইপে সর্বদা প্রেশার থাকে। এ ছাড়াও পরিস্থিতি সাপেক্ষে ইমার্জেন্সির জন্য মেডিক্যাল স্ট্রেচার থেকে শুরু করে ব্রিদিং অ্যাপারেটাস প্রস্তুত রাখা হয়, অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা হয়। সব সময় অতিরিক্ত একজন লোক পাহারায় থাকবে।

সব গ্যাসের পাইপ এবং ওয়েল্ডিং ক্যাবল পরীক্ষা করা হবে, আর্থিং আছে কি না দেখা হবে, গ্যাসের সিলিন্ডারে ফ্ল্যাশ ব্যাক অ্যারেস্টর থাকতে হবে। এমনকি যেসব ব্যক্তি কাজে নিয়োজিত হবে, তারা পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়েছে কি না, সেটাও দেখা হবে।

যে এলাকায় কাজ করা হবে, তার গ্যাস চেক করে নিশ্চিত করা হবে সেখানকার বাতাসে কোনো পেট্রলিয়াম আছে কি না। অক্সিজেন চেক করে নিশ্চিত হতে হবে যে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ অক্সিজেন আছে কি না।

কতক্ষণ পরপর পুনরায় গ্যাস চেক করা হবে, সেটাও নির্ধারিত থাকতে হবে। যেমন: প্রতি ১০ মিনিটে একবার গ্যাস চেক করে ব্রিজে জানানো হবে, ডিউটি অফিসার সেটা টুকে রাখবে।

একজন দায়িত্ববান লোক সুপারভাইজার হিসেবে থাকবে, সে ব্রিজের সঙ্গে নির্ধারিত সময় ব্যবধানে যোগাযোগ করে জানাবে যে সব ঠিক আছে। যদি সে ১০ মিনিট পর না জানায়, ব্রিজ থেকে তাকে উল্টো কল করে নিশ্চিত হবে সব ঠিক চলছে।

যদি কাজটা কোনো পাইপ লাইনে হয়, তাহলে সেই পাইপলাইন আইসোলেট করতে হবে, তাকে ডি-প্রেসারাইজ করতে হবে, পাইপের ভেতরের গ্যাস চেক করতে হবে। সেই পাইপের সঙ্গে পাম্প সংযুক্ত থাকলে এর ফিউজ খুলে নিতে হবে, সেখানে লক বা সিল করতে হবে যাতে কাজ শেষ হওয়ার আগে কেউ চালাতে না পারে।

পাওয়ার আইসোলেশন সার্টিফিকেট ইস্যু হবে। যদি এর সঙ্গে কোনো পাওয়ার টুল মানে গ্রাইন্ডার, কাটার ইউজ করা হয়, তার জন্য আলাদা চেক লিস্ট পূরণ করতে হবে। যদি ট্যাংকের ভেতরে কাজ হয়, তাহলে 'এনক্লোজ স্পেস এন্ট্রি' চেকলিস্ট পূর্ণ করতে হবে।

এসব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর ওয়ার্ক পারমিট প্রস্তুত করা হবে। যারা কাজে থাকবে, যে স্ট্যান্ডবাই থাকবে, যে সুপারভাইজার থাকবে, সবাই সই করবে। সব শেষে ক্যাপ্টেন সই দিয়ে যে কয় ঘণ্টার জন্য প্রযোজ্য, যেমন: ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করবে।

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ: তেলবাহী আমেরিকান ঈগল ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন

Comments

The Daily Star  | English

Political parties want road map to polls

Leaders of major political parties yesterday asked Chief Adviser Prof Muhammad Yunus for a road map to reforms and the next general election.

4h ago