পুলিশের চেইন অব কমান্ড ঠিক হচ্ছে না কেন?

'পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন অ্যাকশনে যেতে, বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার'—এটি সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না সন্দেহ আছে। কেননা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যেকোনো বাহিনীর প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো চেইন অব কমান্ড বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ মান্য করা। আপাতদৃষ্টিতে সেই নির্দেশ বা নির্দেশনা খারাপ মনে হলেও সেটি পালন করা অধস্তনদের অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এর ব্যতিক্রম হয় যখন কোনো একটি বাহিনী বা বাহিনীর অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কোনো আদেশ যদি অধস্তনরা দেশ ও গণবিরোধী মনে করে এর প্রতিবাদ করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছে—সেটিই হচ্ছে প্রশ্ন।

খবরে বলা হয়, রোববার রাজধানীর কাকরাইলের অডিট ভবনের সামনে গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন অডিটররা। এতে কাকরাইলের আশপাশসহ রাজধানীর বড় অংশজুড়ে যানজট তৈরি হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদলকে আলোচনার জন্য ডাকলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

যান চলাচল স্বাভাবিক করতে পুলিশের পক্ষ থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে আন্দোলনকারীদের সড়কের এক পাশে অবস্থান নিতে দফায় দফায় অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা শোনেননি। একপর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক থেকে আন্দোলনকারীদের সরাতে 'অ্যাকশনে' যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বিকার ভূমিকার কারণে বাধে বিপত্তি।

পুলিশের পক্ষ থেকে সাঁজোয়া যান আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) ও জলকামান আনা হয়। আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরে যেতে হ্যান্ডমাইকে দফায় দফায় অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সড়ক ছাড়েননি। এ সময় অধস্তন পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে ডিসি সারোয়ার জাহানকে বলতে শোনা যায়, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি নিয়ে সবাই প্রস্তুত হোন। হ্যান্ডমাইকে তিনি সবাইকে আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা রমনা জোনের এডিসি, রমনার এসি (পেট্রল), রমনা থানার ওসিসহ কয়েক পুলিশ সদস্য ছাড়া অধস্তন আর কাউকে এগোতে দেখা যায়নি।

ডিসি সারোয়ার জাহান দফায় দফায় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের (ফোর্স) উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। বলেন, 'সাহস নিয়ে আপনারা এগিয়ে আসুন।' সেই সময় কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সরাসরি বলতে শোনা যায়, তারা কোনো 'অ্যাকশনে' যেতে পারবেন না।

এমন পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় বিরক্তি প্রকাশ করতে শোনা যায় রমনার ডিসি সারোয়ার জাহানকে। সবশেষে আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরাতে নিজের ব্যর্থতার কথা মুঠোফোনে বলতে শোনা যায় পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসিকে। তিনি তখন বলছিলেন, 'স্যার, কেউ কথা শুনছে না। বারবার বলেছি, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'ঢাকায় পুলিশের অধস্তন পর্যায়ের সদস্যদের বড় অংশই শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের। তাই তারা কথা শুনতে চায় না। অনেকে আবার ঢাকায় নতুন আসায় বিষয়গুলো বুঝে উঠতে পারে না। সব মিলিয়ে আমরা খুবই বিপাকে আছি।'

প্রশ্ন হলো, পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যরা কি তাহলে আগের সরকারের আমলের নিয়োগপ্রাপ্ত বলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে না? বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম ঘটনা কি এর আগে ঘটেছে যে, এক সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যরা পরের সরকারের আমলে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, কাজ করেননি বা বিদ্রোহ করেছেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে এই কাজ করতে না চাওয়া, নিষ্ক্রিয় থাকা কিংবা বিদ্রোহ করছেন এমন সদস্যের সংখ্যা কত, সেটি জানা কি খুব অসম্ভব?

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পরে গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিআইজি পদমর্যাদার একজনসহ পুলিশের মোট ১৮৭ সদস্য কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাদের মধ্যে কনস্টেবল ১৩৬ জন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এই হিসাব দেওয়ার পরদিনই অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কর্মস্থলে যোগদান করেননি তাদের আর কাজে যোগদান করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, তারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হবে।

তার মানে কর্মস্থলে অনুপস্থিত সদস্যের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের সবাই কি সক্রিয় হয়েছেন বা কাজ করতে চাচ্ছেন? যদি সক্রিয় না হন বা ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ পুষে রাখেন; বিশেষ করে কেউ ভেতরে বিদ্রোহী মানসিকতা পোষণ করে রাখেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন—সেটি বিপজ্জনক। ফলে এই ধরনের মানসিকতা পোষণ করছেন কতজন, সেই সংখ্যাটি জানা খুব জরুরি।

যদি সত্যিই এরকম হয়ে থাকে তাহলে তাদের বক্তব্যটিও জানা দরকার যে তারা আসলে কী চান? খোলাখুলিভাবে তাদের কথা বলতে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গণহারে চাকরিচ্যুত করলে দ্রুত সেই পদে লোক নিয়োগ করে কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। তা ছাড়া পুলিশের কাজটি বেশ কঠিন। একজন লোক লিখিত ও মৌখিক এবং শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তাকে হাতে বন্দুক দিয়ে মাঠে নামানো যায় না। তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তাকে বাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখাতে হয়। অপরাধবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো জানাতে হয়। অর্থাৎ এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। সুতরাং একসঙ্গে ১০ হাজার পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করে এক সপ্তাহের মধ্যে সেটি রিপ্লেস করা অসম্ভব ও অবাস্তব। তাহলে সমাধান কী?

সমাধান হলো বাহিনীর সদস্যদের যে মনোবল ভেঙেছে, সেটি ফিরিয়ে আনা। তাদের মধ্যে যে ভয় ঢুকেছে, সেই ভয় দূর করা। একটি বাহিনীর সব সদস্য অপরাধী নন। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান এবং তার আগে বিভিন্ন নির্বাচন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী গণবিরোধী আচরণ করেছেন, এটা ঠিক। অনেকে দুর্নীতি করে শত বা হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তাও ঠিক। এরকম অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। কেউ হয়তো দেশের ভেতরেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের অধিকাংশই তার ঊর্ধ্বতনের আদেশ পালন করেছেন। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে গণহারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। এটি করতে গেলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা সামাল দেওয়া বেশ কঠিন। অতএব, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, এরকম কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাইরে বাকিদের সক্রিয় করা, তাদের মনোবল চাঙা করা, দেশ যে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটি বোঝানো এবং তাদের চেইন অব কমান্ড মানতে বাধ্য করা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, দিন শেষে প্রত্যেকেরই একটা পরিবার আছে। সংসার আছে। পুলিশ বাহিনীর সাধারণ সদস্যদের অধিকাংশই সাধারণ পরিবার থেকে এসেছেন। অধিকাংশেরই এটিই একমাত্র আয়ের পথ। সুতরাং তাদের বেঁচে থাকার স্বার্থেও কিছু বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। পক্ষান্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও এটি উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা যে আদেশ দিচ্ছেন, সেটি দেশ ও মানুষের স্বার্থে কি না; তারা দল-মত-ধর্ম-জাতি-পেশা ও বয়স নির্বিশেষে সবার মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কি না। এক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটাও জরুরি। অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ যিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, তার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার কি অতীতের সরকারগুলোর মতোই পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার তথা নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে নাকি দেশের মানুষের সুরক্ষায় নিয়োজিত রাখবে—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

বলাই হয়, সরকার যদি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে; যদি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন এবং এর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, এখানে চাইলেই যেকেউ দুর্নীতি ও অনিয়ম করে পার পাবে না; যদি বাহিনীর সদস্যদের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় এবং পুলিশ যদি সত্যিই স্বাধীনভাবে এবং একইসঙ্গে চেইন অব কমান্ড মেনে দায়িত্ব পালন করতে পারে, তাহলে দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল করা সময়ের ব্যাপার।

অস্বীকার করা যাবে না, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পরে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে দফায় দফায় নির্দেশনা ও ঘোষণার পরেও 'মব জাস্টিসের' নামে মানুষ খুন বন্ধ হচ্ছে না। প্রায়ই কোথাও না কোথায় পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। অথচ বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনীও মাঠে আছে। তার মানে যারা এসব করছে সরকারের নির্দেশনা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না অথবা তারা কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ যদি সক্রিয় থাকত তাহলে কি মাঠ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটা অবনতি হতো? সেনাবাহিনী এখন মাঠে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয় দেশ ও জাতির জরুরি প্রয়োজনে। অর্থাৎ তাদের দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। বরং এই কাজটি প্রধানত পুলিশের। অতএব পুলিশকে পুরোদমে সক্রিয় করা না গেলে সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি দেখতে হতে পারে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
Income inequality in Bangladesh

Growth obsession deepened rich-poor divide

Income inequality in Bangladesh has seen a steep rise over the past 12 years till 2022, according to official data, as economists blame a singular focus on growth rather than sorting out income disparities.

16h ago