‘জুলাই অভ্যুত্থান’ ও বাংলাদেশি-আমেরিকানদের কিছু চিন্তা

ভিজ্যুয়াল: আনোয়ার সোহেল

যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর আয়োজিত গ্রেগরিয়ান্স অব নর্থ আমেরিকার (জিএনএ) দ্বিতীয় পুনর্মিলনীতে যোগ দিয়ে অভূতপূর্ব লেগেছে। স্কুলজীবনের অসংখ্য চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হলো এই আয়োজনে। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের প্রায় ২০০ সাবেক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন অংশ থেকে এসে এই পুনর্মিলনীতে যোগ দেন। অনেকের সঙ্গেই ছিলেন জীবনসঙ্গী-সঙ্গিনী। এটা ছিল নতুন করে যোগাযোগ, স্মৃতিচারণ, জীবনের গল্প ভাগ করে নেওয়া, স্মরণীয় ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন ও স্কুলজীবনের মতো গল্প-আড্ডায় মেতে ওঠার উপলক্ষ।

আলোচনার সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় ছিল বাংলাদেশের সমীহ জাগানিয়া টেস্ট-খেলুড়ে দেশে রূপান্তরিত হওয়া। কীভাবে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক টেস্ট সিরিজের অসামান্য সাফল্যকে উপজীব্য করে আরও সামনে এগিয়ে যেতে পারি, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়। অনেকেই চলমান ভারত সফর নিয়ে উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেন। এই আলোচনায় সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ বাবু ও খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টুর মতো ক্রিকেট জগতের সাবেক তারকরা অংশ নেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিকের ব্যর্থতা, কঠোর পরিশ্রম ও পরবর্তীতে আসা সাফল্যের ব্যক্তিগত স্মৃতিগুলো তারা আমাদের শোনান। এই অভিজ্ঞজনদের দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ বিষয়ে মন্তব্যগুলো সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন; আর আমরা ভাবতে থাকি, কেন এই তিন তারকা আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃস্থানীয় পদে নেই—বিশেষত যখন বিভিন্ন পেশাদার সংস্থার ওপরের দিকে এতো রদবদলের হিড়িক চলছে।

শাহুদুল হক—আমাদের 'গুল্লু'—এক হাজার ৪২৫ দিনে (তিন বছর ১১ মাস) ১৫ হাজার ৩০০ মাইল হাঁটার অবিশ্বাস্য গল্প শুনিয়ে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেন। তিনি ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন হাঁটছেন। তিনি জানান, যেদিন বৃষ্টির কারণে বাইরে হাঁটতে যেতে পারেন না, সেদিন তার ১৩তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সিঁড়ি দিয়ে ক্রমাগত ওঠানামা করতে থাকেন এবং এটা শেষ হয় তখন, যখন তার দৈনিক ন্যূনতম পাঁচ মাইল হাঁটা পূরণ হয়। তার এই বর্ণনা শুনে আমাদেরই যেন হাঁসফাঁস লেগে ওঠে! চক্রাকারে এই পৃথিবীর এক মাথা থেকে আরেক মাথার দূরত্ব প্রায় ২৫ হাজার মাইল—যার প্রায় অর্ধেক দূরত্ব তিনি ইতোমধ্যে হেঁটে ফেলেছেন। প্রায় ৭৫ বছর বয়সী একজন মানুষের এমন অর্জন নিমিষেই তাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার চোখে বীরে পরিণত করে।

'বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও যেভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে' শীর্ষক সেশনে আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়। সেখানে সবাই যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা মনোযোগের সঙ্গে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে সব খবর রেখেছেন। দেশের অর্জন নিয়ে সবাই গর্বের কথা জানালেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উঠে এসেছে অনিশ্চয়তার সুর; বিশেষত, এতদিন পর যেসব শক্তি মুক্তি পেয়েছে, সেগুলো নিয়ে। কোন কোন বিষয়ে সংস্কার হওয়া উচিত তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত থাকলেও সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নেন যে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে হবে এবং একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকা উচিত না।

কম-বেশি সবাই বিগত সরকার উৎখাতকে স্বাগত জানান। দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা, ক্ষমতার অপব্যবহার, চাটুকারিতা ও জবাবদিহি না থাকাসহ নানা কারণে বাংলাদেশ এমন এক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যে অনেক বছর ধরে বাংলাদেশি হিসেবে তারা বিব্রত হয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকার অবিশ্বাস্য পর্যায়ে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠায় আমাদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরাও স্তম্ভিত হয়েছেন। আমি যতটুকু বিস্তারিত তথ্য তাদেরকে দিতে পেরেছি, সেখানে বিগত সরকারের শাসনামলে সুশাসন প্রক্রিয়ার‍ ক্রমাগত ক্ষয়ের বিষয়টি উঠে এসেছে। আমাদের অনেকের মতোই তারাও অবাক হয়ে ভাবেন যে, কীভাবে এত অল্প সময়ে এবং এতটা অসম্মানজনকভাবে শেখ হাসিনার এত শক্তিশালী সরকারের পতন হলো। মূলত, জনতার শক্তিই এটাকে সম্ভব করেছে।

তারা আমাদের তরুণদের সাহসিকতায় মুগ্ধ। আমাদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থান অনন্য। কারণ, এই আন্দোলনে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী, এমনকি স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও অংশ নেয়। ২০১৮ সালের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন সম্ভবত স্কুলের শিশুদের সড়কে নেমে ন্যায্যতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানানোর মনস্তাত্ত্বিক বাধাগুলোকে দূর করে দিয়েছে। যে প্রবল সাহস ও বীরত্ব নিয়ে অনেক পরিবারের সদস্য ঢাকার সড়কে নেমে এসেছেন, তা অর্জন করতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের বহু বছরের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। পুলিশের নির্বিচার হত্যা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যান এবং তাদের সঙ্গে স্বপ্রণোদিত হয়ে যোগ দেন সবস্তরের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-তরুণ, শিক্ষার্থীদের বাবা-মা, এমনকি শিশুরাও। এসব জেনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বারবার অবাক হয়েছেন। পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির বেপরোয়া গুলির মুখে দিনের পর দিন সামান্যতম ভয় বা হতাশা ছাড়াই বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়া এই আন্দোলন নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসাহসিক গণঅভ্যুত্থানের তালিকায় জায়গা পাবে। গ্রেগরিয়ান্স অব নর্থ আমেরিকার উপস্থিত সদস্যরা মুগ্ধ হয়ে শোনেন, কীভাবে তরুণদের পাশাপাশি তরুণীরাও সমান উদ্যম ও সাহস নিয়ে প্রতিদিন পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছেন। এসব ঘটনায় সমতা, আত্মবিশ্বাস ও নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি প্রবাসীদের অগাধ ভরসা। তারা বিশ্বাস করেন, তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে যেসব সংস্কারের প্রত্যাশা দেশের মানুষ করছে, তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি যথেষ্ট সময় পাবেন কি না, সেটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন প্রবাসীরা। পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য মেয়াদ নিয়ে চলে জল্পনা-কল্পনা।

তার কার্যতালিকায় অনেক বেশি সমস্যা যোগ হচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন উপস্থিত প্রবাসীরা। ড. ইউনূসের ওপর দায়িত্বের বোঝা এতই সুবিশাল যে সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের যেকোনো সাফল্য অর্জনের পথে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তিদের অধীনে ছয়টি কমিশন গঠনের উদ্যোগে তাদের আশঙ্কা অনেকাংশেই দূর হয়েছে। তাদের মনে প্রত্যাশা জেগেছে, অন্তর্বর্তী সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে।

আমাকে যে ব্যাপারটি অত্যন্ত মুগ্ধ করেছে তা হলো, নিউজার্সিতে জমায়েত হওয়া প্রবাসীদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশের আগামীর যাত্রায় সহায়তা করার প্রবল ইচ্ছা। পুরোটা সময়জুড়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসতে থাকে, কীভাবে এই অত্যন্ত দক্ষ বাংলাদেশি-আমেরিকানরা তাদের মাতৃভূমির উন্নয়নের পথে সহায়তা করতে পারেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা, ব্যবসা, প্রকৌশল, তথ্য-প্রযুক্তি, মেডিসিন, ফার্মেসি, এমনকি সাইবারনিরাপত্তা খাতের পেশাদাররাও। যারা সেখানে ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে মধ্যম থেকে উচ্চপর্যায়ে কর্মরত। তারা মার্কিন নাগরিক হলেও, বাংলাদেশের নতুন এই যাত্রায় অংশ নিতে অত্যন্ত আগ্রহী ও ইচ্ছুক।

তারা ভারতীয়দের উদাহরণ টেনে বলেন, ভারতের অগ্রযাত্রায় প্রবাসীদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আগের সরকারগুলো এই উচ্চ প্রশিক্ষিত, বুদ্ধিবৃত্তিক মানবসম্পদকে কোনো কাজে লাগায়নি। প্রবাসীরা বাংলাদেশের সেবা করতে আগ্রহী ও প্রস্তুত এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাও তাদের রয়েছে। তারা একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যমের অপেক্ষায় রয়েছেন—সেটা সরকারি বা বেসরকারি, যেকোনো মাধ্যম হতে পারে। এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে তারা তাদের পেশাদার ও শিক্ষাবৃত্তিক দক্ষতাকে বাংলাদেশিদের কাছে নিয়ে যেতে চান। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে মাথায় রেখে প্রবাসীরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছেন যে, তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে।

তাদের সঙ্গে আমার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ ও বিচ্ছিন্ন আলাপ এটুকু আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে, অপার সম্ভাবনাময় একবিংশ শতাব্দিতে দেশের অগ্রযাত্রায় এই দক্ষ ও একইসঙ্গে উজ্জীবিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে পেশাদারি পর্যায়ের যোগাযোগ স্থাপনের এটাই উপযুক্ত সময়—যাতে তাদের জ্ঞান আমাদের সহায়ক হয়। জরুরিভিত্তিতে প্রতিভার এই সুবিশাল খনিকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য একটি উপযুক্ত প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে, যাতে তা বাংলাদেশের রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে।

ভবিষ্যতের অগ্রযাত্রায় জ্ঞান যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়, তাহলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৈশ্বিক নাগরিকরা দেশকে সেই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আরও আগে তাদের কাছে সহায়তা না চেয়ে আমরা বড় বোকামি করেছি। এখনো যদি আমরা একই পথে হাঁটতে থাকি, তাহলে সেটা শুধু নিজেদের পরাজয়ই নিশ্চিত করবে না, একইসঙ্গে বিষয়টি হবে আত্মহত্যার শামিল।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

18h ago