আয়নাঘরের অভিশাপ

গ্রীক দার্শনিক সফোক্লিসের বিশ্বখ্যাত ট্র্যাজেডি ইদিপাসে অন্ধ সাধকপুরুষ তাইরেসিয়াস নামের একটি চরিত্র আছে। তিনি দেবী এ্যাপোলের আশীর্বাদপ্রাপ্ত একজন ত্রিকালদর্শী দৈবজ্ঞ। মানুষের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ দেখতে পান। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত, বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত আওয়ামী লীগ ঠিক কবে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, সেই দিশা খুব সম্ভবত তাইরেসিয়াসের মতো কোনো সাধুপুরুষই দিতে পারবেন। সেটা আপনার আমার কম্ম নয়।

তবে আওয়ামী লীগকে স্বমহিমায়, শক্তিশালী হয়ে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়া, জুলাই হত্যাকাণ্ড, ভোটাধিকার হরণ, ব্যাংক লুট, মাফিয়াতন্ত্রের বিকাশ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আওয়ামী লীগকে কাফফারা দিতে হবে দীর্ঘদিন।

আমার ধারণা এসবের মধ্যে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি ভোগাবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ। যার জ্বলন্ত সাক্ষী আয়নাঘর। এই আয়নাঘরের অভিশাপ আওয়ামী লীগকে বছরের পর বছর দগ্ধ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

শেখ হাসিনার আয়নাঘর বা গুপ্ত বন্দিশালার খবর বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট সুইডেনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল নেত্রনিউজ-এর মাধ্যমে। আমার পরিষ্কার মনে আছে 'আয়নাঘরের বন্দি: ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দিশালা' শিরোনামের ৩৪ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের অনুসন্ধানী ভিডিও চিত্রটি দেখেছিলাম শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায়।

মানবাধিকার, মানুষের মৌলিক অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেখ হাসিনার সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) কীভাবে মানুষকে গুম করতো, আইন বহির্ভূতভাবে আটকে রাখতো, তা প্রকাশ্যে চলে আসে। যা নিয়ে ওই সময় থেকেই শেখ হাসিনা প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে। যদিও প্রবল প্রতাপশালী শেখ হাসিনার সরকার এই প্রতিবেদন ও বৈশ্বিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপ আমলে নেয়নি। উল্টো চরিত্রহননের পাশাপাশি মামলা-মোকদ্দমায় হেনস্থা করা হয় ওই আলোচিত অনুসন্ধানী ভিডিওর নেপথ্যের মূল চরিত্রদের। সরকার সমর্থিত এক পাল সাংবাদিকও আদা-জল খেয়ে লেগে পড়েছিলেন আয়নাঘরকে মিথ্যা প্রমাণে।

বীভৎস নির্যাতনের আয়নাঘর যে কল্প কাহিনী নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের পর গোপন সেই নির্যাতন কুঠুরি থেকে মুক্ত হয়েছেন ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। মাইকেল চাকমা পাঁচ বছর, মীর আহমদ বিন কাসেম ও আব্দুল্লাহিল আমান আযমী দীর্ঘ আট বছর এই নরকে বন্দি ছিলেন বিনা বিচারে, বিনা অপরাধে।

নির্যাতনের ওই অন্ধকূপ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এই তিনজন যে বর্ণনা দিয়েছেন তা রীতিমতো লোমহর্ষক। প্রতিনিয়ত মৃত্যু ভয়, ভয়ঙ্কর জিজ্ঞাসাবাদ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এই মানুষগুলো ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। মাইকেল চাকমা তো বলেইছেন, মনে হতো কবরে আছি

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে গুম অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারগুলো বিরোধীপক্ষের কণ্ঠরোধ করতে এই পন্থা অবলম্বন করে থাকে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী মত দমনে এই ঘৃণ্য পথ বেছে নেয় শেখ হাসিনার সরকার।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালে পর্যন্ত ৬০৫ জন মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। হয়তো তাদের অনেকের জীবনের শেষ দিনটি কেটেছে আয়নাঘরের কুঠুরিতে। হয়তো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর কলমের খোঁচা অথবা হেয়ালি ইঙ্গিতে কোনো এক মধ্যরাতে থেমে গেছে আয়নাঘরের কোনো বাসিন্দার হৃৎস্পন্দন।

যতদূর জানা যাচ্ছে আয়নাঘরের মূল কারিগর ছিল সামরিক গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই)। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংস্থাটি ছিল শেখ হাসিনার অধীনে। আর তার ছায়া হয়ে সংস্থাটি চালাতেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। নিশ্চিতভাবেই এই দুজন ছাড়াও অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য এই গুপ্ত কারাগার পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডিজিএফআইয়ের কার্যপ্রণালী ও এখতিয়ার নিয়ে আমি খুব ভালো জানি না। শুধু এটুকু জানি, প্রবল ক্ষমতাধর এই সংস্থাটি পরিচালনা করতেন স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা যে প্রায় ঈশ্বর সমতুল্য ক্ষমতার চর্চা করেন, তারই একটি সংযোজন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ওপর তাদের সরাসরি কর্তৃত্ব।

খুব সহজ কথা, ডিজিএফআই সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি গোয়েন্দা সংস্থা। রাষ্ট্রের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান সেনা কাঠামোর বাইরে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন থাকবে? নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সেনা কর্মকর্তারা এর যোগ্য জবাব দিতে পারবেন।

আয়নাঘরের অন্ধকূপ পরিচালনায় শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জড়িত—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিশ্চিতভাবে এর সঙ্গে আরও অনেকেই জড়িত। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া, সবচেয়ে বেশি জরুরি ডিজিএফআইসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার কাঠামোগত সংস্কার। তা না হলে আগামীতে আবারও আয়নাঘরের আবির্ভাব হবে। হয়তো শুধু পরিবর্তন হবে নাম ও ভুক্তভোগীর তালিকা। যা কাম্য নয়। আয়নাঘর সংস্কৃতির অবসান হতে হবে চিরতরে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Are battery-run rickshaws Dhaka’s newest traffic menace? Hear what city dwellers think!

Dhaka's battery-run rickshaws spark debate over efficiency versus safety. Critics cite accidents, recklessness, and safety concerns, while supporters highlight cost-effectiveness. A High Court ban fuels tensions, affecting livelihoods and intensifying calls for regulation over elimination.

2h ago