দুর্নীতি রোধে দ্রুত করনীয়
জনগণের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে গত ১৫-১৬ বছর ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে সরকারকে প্রচুর ছাড় দিতে হয়েছে। দলীয় রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ কাজে পিছিয়ে থাকেনি, গড়েছে সম্পদের পাহাড়। জনগণের সামনে এসেছে অল্প কিছু নজির।
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, বিগত বছরগুলোতে ঘুষ ছাড়া সরকারি অফিসে কয়টি 'সেবা' নিতে পেরেছেন? আমার বিশ্বাস একটিও না। অতি অল্প কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী একান্ত পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে দুর্নীতিমুক্ত আছেন। তবে তারা স্ব স্ব কার্যালয়ে অত্যন্ত নিগৃহীত ও তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবাজরা ঘাপটি মেরে বসে থাকার কথা। দুর্নীতির পথ বন্ধ না হলে সুযোগ বুঝে আবারো তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সেজন্য আর্থিক দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করতে এই সরকারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, কয়েকটি বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ নিয়ে সেই টাকা নগদে উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করেছে অথবা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। আইনি দুর্বলতা, ব্যাংক পরিচালকদের চাপ অথবা স্বেচ্ছায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোই ঋণের এই টাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে নগদ টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়ে পরোক্ষভাবে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। এই শ্রেণীর দুর্নীতি খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়, যেহেতু ব্যাংকিং লেনদেনের মাধ্যমে ঋণের টাকা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে জমা হয়। তবে দরকার শুধু সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদিচ্ছার।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে 'সেবা' দেওয়ার সময় সগৌরবে ঘুষ নিয়ে থাকেন—যার আরেক নাম 'স্পীড মানি'। এই 'সেবা' বাস্তবিক অর্থে সেবা নয়, বরং অনৈতিক, অন্যায্য ও আইন বহির্ভূত সুবিধা প্রদান। সম্পূর্ণভাবে নগদ অর্থে লেনদেন হওয়ার কারণে এই ধরনের আর্থিক দুর্নীতি উদঘাটন করা তুলনামূলকভাবে কঠিন।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে দেশের এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী প্রকৃত অর্জিত মুনাফার যৎসামান্য প্রদর্শন করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেয়। যেমন: ধরুন একজন ব্যবসায়ী তার বিভিন্ন সূত্রের আয়ের ওপর ১০০ টাকা কর প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ উদঘাটন করতে পেরেছেন যে তিনি আয় গোপন করেছেন, যার ওপর আরও ১০০ টাকা কর প্রদান করা উচিত ছিল। এবার শুরু হবে সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং ওই ব্যক্তির মধ্যে দর কষাকষি—কে কাকে কত টাকার সুবিধা দেবে। বাস্তবে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের পেছনে ১৫ থেকে ২০ টাকা স্পীড মানি খরচ করলে ওই ব্যক্তি ১০০ টাকার রাজস্ব এড়িয়ে যেতে পারেন।
লক্ষ্য করে দেখুন, উপরের উদাহরণে সরকার—পক্ষান্তরে জনগণ—বঞ্চিত হলো ১০০ টাকা রাজস্ব থেকে; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী স্পীড মানি পেয়ে গেল ২০ টাকা; যদি কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকেন, তিনিও হয়তো ৫-১০ টাকার একটা ভাগ বসাবেন।
যদি রাজস্ব অফিসগুলোতে গিয়ে থাকেন, এই চিত্রই দেখতে পেয়েছেন বিগত বছরগুলোতে। এভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা মালিক হচ্ছে কালো টাকার, সৎ ব্যবসায়ীরা পণ্যের বাজারমূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না, আর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মালিক হচ্ছে অবৈধ সম্পদের—কোরবানির ছাগল বিক্রি হচ্ছে ১৫ লাখ টাকায়। অনেকেই আবার এই টাকায় করছেন হজ্জ, ওমরাহ, মসজিদ নির্মাণ ও বিভিন্ন সমাজসেবা।
আর্থিক দুর্নীতি প্রতিরোধে খুব বেশি প্রতিকার ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। একটি সহজ উপায় হলো আর্থিক কর্মকাণ্ডে নগদ টাকার ব্যবহার কমানো। সব দুর্নীতির মূল হচ্ছে নগদ অর্থের অবাধ প্রবাহ। যদি নগদ অর্থের প্রবাহ কমাতে পারি, অধিকাংশ দুর্নীতিই কমে যাবে।
উন্নত বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে নগদ টাকার ব্যবহার খুবই কম—একেবারে নগণ্য। হ্যাঁ, প্রশ্ন করতেই পারেন যে আমাদের দেশে কি এই মুহূর্তে সেটা করা সম্ভব? আমিও বলবো খুব দ্রুত সম্ভব নয়। তাই বলে কিছু না করে বসে থাকলেও হবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। দুটি কাজ করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক—
১. ট্রেড লাইসেন্সধারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বেঁধে দিতে পারে সর্বোচ্চ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের সীমা, যা ইতোমধ্যেই ইনস্যুরেন্স ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের নগদ টাকা উত্তোলনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেসব ব্যবসায়ী সরাসরি প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করেন, তাদেরকে এই ব্যবস্থার বাহিরে রাখতে হবে। তাছাড়া, দেশে বিদ্যমান আয়কর আইনে ৫০ হাজার টাকার বেশি কোনো খরচ নগদ টাকায় পরিশোধ করলে তা যেহেতু অগ্রহণযোগ্য খরচ হিসেবে বিবেচিত হয়, সেহেতু ব্যাংক একাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা নগদ উত্তোলনের সুযোগ থাকার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ ও সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করার জন্য বিদ্যমান ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট (সিটিআর) ও সাস্পিশাস ট্রানজেকশন রিপোর্ট (এসটিআর) নামে দুটি কার্যক্রম চালু আছে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এগুলো থাকার পরও হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে লোপাট হয়? দেশ ও জনগণের প্রতি কি তাদের ন্যূনতম দায়বোধটুকুও নেই?
২. কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ব উদ্যোগে মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের একটা প্ল্যাটফর্ম করতে পারে, যা হবে সহজ ও নিরাপদ। দেশের জনগণকে ধীরে ধীরে নিয়ে আসতে হবে এই প্ল্যাটফর্মে, তারা যেন দৈনন্দিন লেনদেন এখান থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারেন কোনো রকম বাড়তি খরচ ছাড়া। এতে বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং দুর্নীতির পরিসরও কমতে শুরু করবে।
একটি কথা না বললেই না, দুর্নীতির টাকার নিরাপদ ও গোপন ব্যবহারের উৎকৃষ্ট খাত হচ্ছে আবাসন। দেশের আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক ভবনের একটা বিরাট অংশ ক্রেতা তার নিজের নামে নিবন্ধন করতে অনেক বিলম্ব করেন, ফলে এগুলো ক্রেতার সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শন না করার সুযোগ থেকে যায়। আর যেগুলো নিবন্ধিত হচ্ছে, সেগুলোও প্রকৃত বাজার মূল্যে নিবন্ধিত হয় না।
দেখা যায়, কেউ ১০০ টাকার সম্পদ কিনে তা বিদ্যমান আইন পরিপালন করেই মাত্র ৩০ থেকে ৪০ টাকায় নিবন্ধন করান। এতে একদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে তার প্রাপ্য নিবন্ধন ফি থেকে, অপরদিকে দুর্নীতিবাজ ক্রেতারা তার অবৈধ টাকার ৬০-৭০ শতাংশ টাকা আড়াল করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে উদঘাটন করা হয়ে যাচ্ছে দুরূহ।
আশা করি বর্তমান সরকার দুর্নীতি রোধে নগদ টাকার ব্যবহার হ্রাস এবং অনিবন্ধিত অ্যাপার্টমেন্ট ও বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোকে দ্রুত নিবন্ধিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করবে যে হস্তান্তরিত সম্পত্তিগুলো প্রকৃত বাজারমূল্যে নিবন্ধিত হচ্ছে।
ঢালী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, এফসিএ
Comments