শতাব্দী পেরিয়ে রনো

রনোর ভাষায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহত্তম ঘটনা। এই ঘটনার প্রভাব ও পরিণতি সে সময় মাও সে-তুংয়ের চীন যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি।
শতাব্দী পেরিয়ে রনো
হায়দার আকবর খান রনো | ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ২০০৪ সালে 'সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিষয়াবলী' নামে একটি কোর্স পড়েছিলাম। অকাল প্রয়াত অধ্যাপক সিতারা পারভীন খুব যত্ন করে কোর্সটি পড়িয়েছিলেন। সেই কোর্সে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে একটি টপিক ছিল। ক্লাসে ম্যাডামের দুর্দান্ত আলোচনা এই বিষয়ে আমাকে জানতে বেশ আগ্রহী করে তোলে।

বিশেষ করে ১৯৭১ সালে কেন বামপন্থীরা বিভক্ত ছিলেন, কেন তারা কিছু ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত ছিলেন, এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। পরের দিকে বিভিন্ন নিবন্ধ, বই ও সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধে বামধারার রাজনীতিকদের ভূমিকা জানার চেষ্টা করতাম। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ফোন দিয়েছিলাম হায়দার আকবর খান রনোকে।

সাক্ষাতের সময় চাইলে অনেক আন্তরিকতার সঙ্গে পরের দিন যেতে বলেন। ঠিকানা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিবেশী। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের কয়েকটি বাড়ি পার হয়েই তাদের বাসা।

শতাব্দী পেরিয়ে রনো
ছবি: সংগৃহীত

ছোটখাটো গড়নের, মৃদুভাষী এই মানুষটি পর দিন সন্ধ্যায় আন্তরিকতার সঙ্গে তার বাড়িতে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দীর্ঘ আলাপে তুলে ধরেছিলেন ১৯৭১ সালের তাদের রাজনীতি ও মুক্তি সংগ্রামের অবস্থান। জানিয়েছেন অনেক অজানা তথ্য। তার কাছে প্রথমেই জানতে চেয়েছিলাম, একাত্তর সালে বাম রাজনীতিকদের ঠিক কয়টি উপদল ছিল? আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই প্রশ্ন শুনে তিনি একটু হেসেছিলেন। বলেছিলেন, এই প্রশ্ন অনেক সাংবাদিক তাকে করেছেন। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে রনো জানিয়েছিলেন, 'বামপন্থী রাজনীতিতে কট্টর বিভাজনটা শুরু হয় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। পূর্ব পাকিস্তানে এই বিভাজন কার্যকর হয় ১৯৬৬ সালে। কমরেড মণি সিংয়ের নেতৃত্বে মস্কোপন্থীরা আলাদা লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হন। চীনপন্থীদেরও ছিল আলাদা তৎপরতা। আর একাত্তরে বামদের মধ্যে চারটি ভাগ ছিল। যারা আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করেছে।

'পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু-দস্তিদার-তোয়াহা-হক এবং অন্য অংশের নেতৃত্বে ছিলেন দেবেন শিকদার-আবুল বাশার, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কিমিটির নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর-মেনন-মান্নান ভূঁইয়া আর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, যা সর্বহারা নামে পরিচিত ছিল—সেই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজ সিকদার। আমি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কিমিটির সক্রিয় কর্মী ছিলাম। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। সে সময় আমরা মুক্তিযুদ্ধে চীনা ভূমিকার প্রকাশ্য সমালোচনা করেছি। যার কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর রুষ্ঠ ছিল। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চীনা অ্যাম্বাসি আমাদের কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেনি। যদিও ওই সময়, মানে আশির দশক আমি ওয়ার্কার্স পার্টি করতাম,'—কী সরল-সোজা বিশ্লেষণ ছিল হায়দার আকবর খান রনোর।

ওই সন্ধ্যায় আরও অনেক আলাপ হয়েছিল। কোন প্রেক্ষাপটে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি তথা রাশেদ খান মেননের কাছ থেকে সরে এলেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। সে সময় তার কণ্ঠে ছিল কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা হতাশা। যাই হোক, সাক্ষাৎকার শেষে ফেরার সময় হায়দার আকবর খান রনো একটি অমূল্য উপহার দিয়েছিলেন। 'শতাব্দী পেরিয়ে' শিরোনামে রনোর ৫২০ পৃষ্ঠার এক অমূল্য গ্রন্থ। যা পরের একমাস এক ধরনের ঘোরলাগা ভালো লাগা নিয়ে পড়েছি।

'শতাব্দী পেরিয়ে' হায়দার আকবর খান রনোর আত্মজীবনী। যার শুরু ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুভাষ চন্দ্র বসুর ভারত স্বাধীন করার প্রচেষ্টার একটি চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়ে। যুদ্ধের সময় সুভাষ চন্দ্র বসু কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, ভারতবাসী তাকে কতটা ভালোবাসতেন—তার এক বিশ্লেষণ পাওয়া যায় শতাব্দী পেরিয়ে বইটিতে। এখানে মজার একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন রনো। সে সময় কলকাতার সংবাদপত্রে যুদ্ধের প্রকৃত খবর পাওয়া যেত না; শুধু ব্রিটিশদের সাফল্য আর যুদ্ধ জয়ের খবর ছাপা হতো। কোথাও সুভাষ চন্দ্র বসুর ভারত স্বাধীন অভিযানের ছিটেফোঁটাও থাকতো না। সে সময় কলকাতার হকাররা বিশেষ একটি কৌশলে সংবাদপত্র বিক্রি করতেন। তারা সংবাদপত্র বিক্রি করতে করতে উচ্চ স্বরে বলতেন, 'সিধা পড়ে উল্টো বুঝুন'।

তবে ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত রনোর আত্মজীবনীতে সব কিছু সিধাই পাওয়া যায়। এখানে উল্টো করে বুঝতে চাওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। বইটিতে তিনি সরাসরি বলেছেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট রাজনীতির অনেক সংকট ছিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল, এই দলের বেশির ভাগ সদস্য ছিলেন হিন্দু পরিবার থেকে আগত।' (পৃষ্ঠা: ২৫) যে কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো তাদের ওপর কঠোর নির্যাতন চালায়। আর সে কারণেই কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কী সরল স্বীকারোক্তি।

হায়দার আকবর খান রনোদের নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। গ্রন্থটিতে ভাসানীর প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। কিন্তু তার নেতা বলে রনো যে ভাসানীকে শুধু প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়েছেন ব্যাপারটি তেমন নয়। তিনি গ্রন্থটিতে ভাসানীর তীক্ষ্ম সমালোচনা করেছেন। যেমন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ১৯৬৯ সালে শাহপুর সম্মেলনে ভাসানী স্লোগান দিয়েছিলেন 'ভোটের আগে ভাত চাই'। রনো উল্লেখ করেছেন, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই অবস্থান সঠিক হয়নি। এই স্লোগান জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল। বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। এছাড়া, অনেক সময় অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন চীনপন্থী বামধারার রাজনীতির ভুল-ত্রুটি ও অসাড়তা। রনোর ভাষায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহত্তম ঘটনা। এই ঘটনার প্রভাব ও পরিণতি সে সময় মাও সে-তুংয়ের চীন যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি।

মহাজীবনের এই গল্পে রনো নকশাল রাজনীতি নিয়ে তুলে ধরেছেন অনন্য এক হৃদয়গ্রাহী বিশ্লেষণ। সাহিত্যিক, সাংবাদিক সরোজ দত্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মহানায়ক উত্তম কুমারের একটি ঘটনা দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটিতে।

'শতাব্দী পেরিয়ে'তে বারবার এসেছে রনোর শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনের নানা ঘটনা। বিশেষ করে টঙ্গী এলাকায় কীভাবে তারা শ্রমিক আন্দোলন করেছেন, কীভাবে প্রতিকূল পরিবেশে পার্টির জন্য কাজ করেছেন সেসব ঘটনা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন রনো। এছাড়া, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের এক ভিন্ন চিত্র অত্যন্ত নির্মোহভাবে উঠে এসেছে রনোর গ্রন্থে। যেখানে তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ১৯৭২-৭৫ সময়ের এমন বিশ্লেষণ আর কারও গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এছাড়া, ৭৩-৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়েও আছে এক বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

এরপরে এসেছে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, জিয়া ও এরশাদের আমলসহ নানা বর্ণনা। ইতিহাসের এই পালা বদলের ইতিহাসগুলো সুনিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন একজন হায়দার আকবর খান রনো। ৫২০ পৃষ্ঠার বিশাল এক ক্যানভাসে রনো যে রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র এঁকেছেন, তা ছোট্ট এই নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে একটি কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে, পুরো এই গ্রন্থটিতে যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, সেখানে ছিল না কোনো ধরনের আত্মস্তুতি আর সাফাই।

পুরো গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সততা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতির নানা ঘটনা, যা একজন পাঠককে মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
  
পুনশ্চ: ১১ এপ্রিল সকালে যখন হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন ঢাকার বুকে কান্না হয়ে ঝরছে বৃষ্টি। কেন যেন মনে হয়, রনোর স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কিছুটা সান্ত্বনা দিতে সাতসকালে ঢাকার প্রকৃতিতে বৃষ্টির আগমন। অথবা এই বৃষ্টি হয়তো শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া এক মহাজীবনকে শেষ শীতলতার স্পর্শ দিলো।

রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments