ক্ষমতার উন্মত্ত বহিঃপ্রকাশের নামই ‘ধর্ষণ’
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে পাঁচ বছর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের রাতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় যেদিন (৫ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন বহিষ্কৃত নেতাসহ ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো, সেদিন দিবাগত রাতে সেই সুবর্ণচরেই ঘরের সিঁধ কেটে ঢুকে মা-মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি সুবর্ণচর উপজেলার চরওয়াপদা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল খায়ের মুন্সিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগেও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও ধর্ষণ এবং নারীকে বিবস্ত্র করে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ঘটনায় মামলাও হয়েছে।
সবশেষ ঘটনার তিনদিন আগে দেশের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ নেতাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মামলার প্রধান আসামিসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান সাগর, সাগর সিদ্দিক ও হাসানুজ্জামান।
এর সপ্তাহখানেক আগে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ফিল্মি স্টাইলে তুলে নেওয়া হয় এক তরুণীকে, যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২৮ জানুয়ারি বিকেল ৫টার দিকে হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার পর দরজার সামনে অপেক্ষারত মা ও ভাইয়ের সামনে থেকে ২০-২৫ জন যুবক তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে যায়। এ সময় হাসপাতালের ভেতরে থাকা লোকজন অভিযুক্ত ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমদের চাচাতো ভাই রুদাঘরা ইউপি চেয়ারম্যান গাজী তৌহিদুজ্জামানকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
এর আগে ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গাজী এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন ওই তরুণী। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে অনেক দিন ধরে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। অর্থাৎ এখানেও অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন একই বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী। গত ৩১ জানুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হলো, সুর্বণচরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার অভিযোগে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার রায় ঘোষণার আগের দিনে সেই সুবর্ণচরেই আরেকটি ধর্ষণের ঘটনা কি নিতান্তই কাকতালীয়? ধর্ষণের ঘটনায় বারবার কেন সুর্বণচর আলোচনায় আসছে? দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা ঘটলেও এই ধরনের ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন সবচেয়ে বেশি সমালোচিত? নোয়াখালী, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন ঘটনায় বারবার কেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নামই আসছে? কেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন সহিংসতার অভিযোগ ওঠে? তার মানে ক্ষমতার সঙ্গে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির সম্পর্ক রয়েছে? এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী?
ক্ষমতা কেবলই রাজনৈতিক নয়। পদ-পদবি, আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক খ্যাতিও একধরনের ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার উন্মত্ত প্রকাশ ঘটাতে গিয়েই মূলত ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সুযোগসন্ধানী, স্বনিয়ন্ত্রণে অক্ষম এবং বিকৃত রুচির ক্ষমতাবান পুরুষ সুযোগ পেলেই অধস্তন, দুর্বল বা বিপদাপন্ন নারীর শয্যাসঙ্গী হতে চায়। তাদের প্রস্তাবে রাজি না জোর করতে শুরু করে বা ধর্ষণ করে। অনেক সময় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও এই ধরনের ঘটনা ঘটে।
সুবর্ণচরের ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তিটি পুরুষ হলে তাকে হয়তো শারীরিকভাবে আহত করা হতো। কিন্তু ভুক্তভোগী নারী বলে তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা বা তাকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার বদলে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে ক্ষমতাবানরা মূলত দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে। প্রথমত, প্রতিশোধ গ্রহণ এবং দ্বিতীয়ত, নিজেদের বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানো।
অর্থাৎ, ধর্ষণের মধ্য দিয়ে কেউ যখন কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, সেখানে সাধারণত ক্ষমতার বিকারটাই মুখ্য; শারীরিক আনন্দ লাভ নয়।
সুর্বণচর, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে, ঠিক সেই সময়ে পুলিশি নির্যাতনে পুরান ঢাকার একজন বডিবিল্ডারের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পুলিশ তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তাকে তাদের শয্যাসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। অর্থাৎ এখানেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিকৃত প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছিল একজন বিপদগ্রস্ত নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।
কেন ধর্ষণ বন্ধ হয় না বা সভ্য ও উন্নত বিশ্বেও কেন ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে নানা মত ও বিশ্লেষণ রয়েছে। যে ব্যাপারে সবাই একমত তা হলো—শুধু একটি বিচ্ছিন্ন কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে না বা হুট করে কেউ ধর্ষক হয়ে ওঠে না। এ জন্য তার বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিকতা, শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি, আইনের প্রতি ভয়-আস্থা ও শ্রদ্ধা, নারী ও শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা-মমত্ববোধ-ভালোবাসা, নারীকে কতটা নারী ভাবে আর কতটা মানুষ, যে সমাজে বাস করে সেই সমাজে মানুষকে মানুষ ভাববার মতো মানুষের সংখ্যা কতো ও সেখানে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের কতখানি সুযোগ রয়েছে—এরকম অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজে করে।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত। অনেক বড় বড় অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে—এমন খবরও এসেছে। অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তা ঘুষ খেয়ে বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে দুর্বল রিপোর্ট দেন, যাতে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। ফলে ক্ষমতাবান অভিযুক্তরা বেরিয়ে যায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার মাত্র ২০ ভাগ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। বাকি প্রায় ৮০ ভাগ থেকে যায় বিচারের বাইরে। ফলে আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের এই ভরসাহীনতা, বিচার পাওয়ার সহজ পথ না থাকা, প্রভাবশালীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে নিজের ও পরিবারের জন্য আরও বড় হুমকি তৈরির যে শঙ্কা, তাও সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো ব্যাধি নির্মূলের একটি বড় অন্তরায়।
মুদ্রার অন্যপিঠ হলো, ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন। আবার অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা বা শ্লীলতাহানির মতো অভিযোগ আনা হয়। ফলে এ জাতীয় অভিযোগ উঠলে শুরুতেই সেটি বিশ্বাস করাও কঠিন। আর এই ধরনের মিথ্যা মামলা বা অপবাদের ঘটনাও প্রায়শই সামনে আসায় প্রকৃত ঘটনাও অনেক সময় বিশ্বাস হতে চায় না।
তার ওপর যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা। কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই সেটি নিয়ে এত বেশি এবং এত ডাইমেনশনে কথাবার্তা হয় যে, আদালতে বিচারের আগেই জনপরিসরে বিচার হয়ে যায়। যেকোনো অপরাধে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এটিও একটি বড় সমস্যা।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments