‘মান্দালা’ ব্যবস্থার দিকে নতুন মিয়ানমার

মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী তরুণেরা দলে দলে গেরিলা দলগুলোতে যোগ দিচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

জানুয়ারি মিয়ানমারের বিজয়ের মাস। ১৯৪৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭৬ বার জানুয়ারি এসেছে এই দেশে। এরমধ্যে দুটো জানুয়ারি বেশ অন্যরকম। একটা ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি, আরেকটা এবারের। 

স্বাধীনতার অল্প কয়দিন আগে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মূল সমন্বয়কারী অং সান মারা গিয়েছিলেন। তারপরও ৭৬ বছর আগের জানুয়ারিতে বহুত্ববাদী ফেডারেল এক দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল বামার, কাচিন, কারেন, চিনরা। ঠিক একইরকম উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে এই জানুয়ারিতে বার্মাজুড়ে। 

ইতোমধ্যে দেশটির নাম পাল্টে মিয়ানমার হয়েছে। কিন্তু সেই পুরানো 'বার্মা' যেন সশস্ত্র হয়ে জেগে উঠছে নতুন নামের সঙ্গে পুরানো অধরা স্বপ্নের মিলন ঘটাতে। ৭৬ বছর আগের স্বাধীনতার অপূর্ণতা মেটাতে চায় এ দেশের মানুষ। তাদের এই সমরযাত্রা কবে শেষ হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে শুরুটা বেশ স্পষ্ট।

মিয়ানমারের এই মোড় বদল প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ছাড়াই। প্রতিবেশীরা এখন কী করবে— সে প্রশ্নও মাঠে আছে।

বন-জঙ্গলের চিরায়ত এক গেরিলা লড়াই

সমকালীন বিশ্বে গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর-আশির দশক ছিল গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের কাল। এ শতাব্দীতে শুরু হয়েছে গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার মহামারি। রাজনৈতিক গেরিলাযুদ্ধের অল্প কয়টি পকেট কেবল টিকে আছে দুনিয়ায়। মধ্যপ্রাচ্যে হামাস নিশ্চয়ই এই তালিকায় সবার ওপরে আছে। এশিয়ায় একইরকম বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে মিয়ানমারের গেরিলারা। 

ফিলিস্তিন ও মিয়ানমারের ঘটনার রাজনৈতিক ফারাক সবার জানা। একদল লড়ছে মাতৃভূমি দখলদার মুক্ত করতে, আরেকদল চাইছে রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতন্ত্র। দুই উদাহরণের মাঝে সামরিক দিক থেকেও একটা বড় অমিল আছে। হামাসের লড়াইয়ের ধরন শহুরে গেরিলা যুদ্ধের মতো, আর মিয়ানমারে চলছে চিরায়ত ঐতিহ্যের বন-জঙ্গলের লড়াই। হামাসের যুদ্ধক্ষেত্র বিশ মাইলের মতো একটি এলাকা। বামার, কাচিন, কারেন, চিনরা লড়ছে কয়েক লাখ বর্গ কিলোমিটার-জুড়ে। দুটোই সমরবিদদের কাছে আলাদা করে মনোযোগ পাওয়ার মতো। দুই জায়গার রাজনৈতিক তাৎপর্যই যুদ্ধাঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে আশেপাশের বহু অঞ্চলে ছড়াচ্ছে, সামনে আরও জড়াবে তাদের। তবে মিয়ানমারের গেরিলাদের ইরানের মতো কোনো 'বন্ধু' নেই। যেমন আছে হামাসের। 

যে যার মতো 'মুক্তাঞ্চল' বাড়াচ্ছে

মিয়ানমার সাতটি প্রদেশ ও সাতটি বিভাগ মিলিয়ে একটা দেশ। বিভাগের প্রধান বাসিন্দা বামাররা। দেশের মাঝের অংশে পড়েছে বিভাগগুলো। প্রান্তিক এলাকায় প্রদেশসমূহ। প্রদেশের মানুষরা ছোট ছোট অ-বামার জাতি। প্রদেশগুলোতে বহুকাল ধরে গেরিলাযুদ্ধের অস্তিত্ব ছিল। বিভাগে সেরকম নজির ছিল কম। পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু বামার-প্রধান সেনাবাহিনীর হাতে ছিল সেকারণে অস্ত্র হাতে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো দরকার ছিল না 'বিভাগ'র বামারদের। গত দুই বছরে সেই 'অঘটন' ঘটলো। গণতন্ত্র ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে বামার ছেলে-মেয়েরা এখন গ্রাম-শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে পুরো মিয়ানমারে অল্পবিস্তর গেরিলা যুদ্ধের আঁচ লেগেছে। রাজধানী নেপিদো বা প্রধান শহর রেঙ্গুনকে যুদ্ধ এখনো চেপে ধরেনি বটে, তবে প্রান্তিক এলাকা গেরিলাদের কব্জায় চলে গেছে ধীরে ধীরে।
 
গত বছরও প্রতিরোধের ধরন ছিল চোরাগোপ্তা। এই জানুয়ারিতে গেরিলারা নিয়মিত বাহিনীর মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছে, নিয়ন্ত্রণে আসা অঞ্চলগুলোতে প্রশাসন চালাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন সামরিক চৌকির পতন ঘটছে তাদের হাতে। দেশটির ৩৩০টি 'টাউনশিপে'র মধ্যে অর্ধেক এখন আর আগের মতো আর্মির নিয়ন্ত্রণে নেই।
 
মিয়ানমারে গেরিলা অগ্রযাত্রার ডিজিটাল চেহারাটাও বেশ কৌতূহল উদ্দীপক। গণতন্ত্রপন্থী 'ছায়া সরকার' ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ক্রিপ্টো কারেন্সি-ভিত্তিক নিজস্ব ব্যাংক গড়ে তুলেছে কয়েক মাস আগে। সেই অনলাইন ব্যাংকের শেয়ার বেচে মাত্র দশদিনে তারা দশ মিলিয়ন ডলার যুদ্ধ-খরচ যোগাড় করেছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির এই ব্যাংকে অন্তত দশটি দেশের মুদ্রায় লেনদেন করা যাচ্ছে। এসবে মাঠের যুদ্ধে বেশ গতি এসেছে। তবে এত বড় পরিসরে যুদ্ধ চালানোর জন্য এখনো খুব অর্থসংকটে আছে এনইউজি। তারপরও গত অক্টোবর থেকে দেশটির গেরিলারা বাকি বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। বান্দরবান থেকেও প্রায়ই তুমুল গোলাগুলির শব্দ কানে আসে। আগে বিভিন্ন প্রদেশ ও বিভাগে বিভিন্ন গেরিলা দল বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালালেও এখন কয়েকটি অ-বামার দল জোট বেঁধে অভিযান পরিচালনা করছে। অন্য গেরিলারাও নিজ নিজ এলাকায় এই সুযোগে যার যার 'মুক্তাঞ্চল' বাড়িয়ে নিচ্ছে।

'মান্দালা ব্যবস্থা' গড়তে চায় গেরিলারা

আগামী দুই সপ্তাহ শেষে মিয়ানমারে সামরিক শাসনের তিন বছর পূর্তি হবে। প্রথম বছর তরুণদের প্রতিবাদ অহিংস চরিত্রের ছিল। সেই হিসাবে সশস্ত্র প্রতিবাদের বয়স এখন ২৪ মাস। মোটাদাগে দুটি শক্তি মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগ্রাম এগিয়ে নিচ্ছে এ মুহূর্তে। অ-বামার গেরিলাদলগুলো চাইছে মিয়ানমারকে প্রদেশগুলোর ফেডারেশন আকারে গড়ে তুলতে। সশস্ত্র বামার তরুণ প্রজন্মের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) চাইছে সেনা শাসনের অবসান শেষে গণতন্ত্র। উভয়ের চাওয়া এক জায়গায় এসে কেবল মিলে। উভয়ে বলছে, তারা সেনাবাহিনীর তৈরি সংবিধান বাতিল করে নতুন একটা সংবিধান লিখবে। যেখানে নাগরিকত্বের শর্ত থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা পর্যন্ত সব কিছুর আমূল গণতন্ত্রায়ন হবে। মিয়ানমার হবে চূড়ান্ত বিকেন্দ্রীকৃত দেশ। যেখানে শক্তিশালী 'কেন্দ্র' গড়ার চেয়ে 'প্রান্তগুলোর' সমন্বয়ে জোর দেওয়া হবে বেশি। জাতিগুলো নিজ এলাকায় স্বশাসনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় একটা ফেডারেশনে যুক্ত থাকবে। শান প্রদেশের 'ওয়া' জাতি সেরকম ব্যবস্থার মধ্যেই আছে বহুকাল। ফলে মিয়ানমারে এরকম রাজনৈতিক মডেল অসম্ভব কল্পনা মনে হয় না। তারা এটাকে বলে 'মান্দালা ব্যবস্থা'। 

আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশের ইতিহাসে এরকম রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। যেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চেয়ে স্থানীয় শক্তির ভূমিকা বেশি থাকে। বান্দরবান ও মিজোরাম লাগোয়া চিন প্রদেশে গেলে যে কেউ এখন দেখতে পাবেন চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও গণতন্ত্রপন্থী গেরিলারা জান্তার বোমাবর্ষণের মাঝেই প্রদেশের অন্তত ৭০ ভাগ এলাকায় নতুন এক নিজস্ব স্বশাসন গড়ে তুলছে। নিজস্ব শিক্ষাবোর্ড দিয়ে স্কুলগুলো চালাচ্ছে তারা। গড়ে তোলা হচ্ছে নিজস্ব বিচার কাঠামো। তৈরি হয়েছে প্রদেশের নিজস্ব সংবিধান। বলাবাহুল্য, মিয়ানমারের কোনো কোনো প্রতিবেশীর জন্য এরকম সংস্কারের খবর অস্বস্তিকরও হতে পারে। 

প্রতিবেশীদের ভাবনা-দুর্ভাবনা

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের সীমানা। সব প্রতিবেশীর তীক্ষ্ণ নজর এখন তার দিকে। ঘটনাবলীতে সরাসরি যুক্ত চীন। বিবদমান প্রায় সব পক্ষকে তারা যুদ্ধের রসদ দিচ্ছে। যুদ্ধ থামানোর আলোচনায়ও আছে তারা। সম্প্রতি চীন গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে নেপিদো সরকারের কয়েক দফা সমঝোতা বৈঠক করিয়েছে। তাতে অবশ্য মাঠের কামান-বন্দুক থামেনি।

আরেক প্রতিবেশী ভারতের দাবি, তার মনিপুর জ্বলছে মিয়ানমারের গেরিলাযুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। থাইল্যান্ডে চলতি যুদ্ধের আগে থেকে মিয়ানমারের ৯০ হাজার শরণার্থী ছিল, গত দুই বছরে গেছে আরও ৪৫ হাজার। প্রতিদিনই কিছু মানুষ মিয়ানমার থেকে থাই সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে। আর বাংলাদেশে তো একসঙ্গে প্রায় আট লাখ এসেছিল- এখন যে সংখ্যা বারো লাখ হলো বোধহয়।

প্রশ্ন উঠেছে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে গেরিলারা জিতলে এসব দেশ কী করবে? ভবিষ্যতের মিয়ানমার নিয়ে কার প্রস্তুতি কেমন? মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেরে গেলে প্রতিবেশীদের কার কী লাভ-ক্ষতি?

চীনের উদ্বেগটা বেশ চোখে পড়ছে। ১৩০০ মাইল বর্ডার আছে দুই দেশের। তার চেয়েও বড় বিষয়, মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগ বিপুল। চলতি সামরিক জান্তার আমলে বিশ্বের বহু দেশ যখন সরকারকে বয়কট করছিল বেইজিং তখনো মুক্তমনে তাদের মদদ দিয়ে গেছে। কেবল গত তিন বছরে একশ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তারা এ দেশে। দক্ষিণের রাখাইন থেকে নিজেদের ইউনান পর্যন্ত রেলপথ বসাতে চায় চীন। যা তাকে ভারত মহাসাগরে অবাধ যোগাযোগ সুবিধা দেবে। কাচিনে তারা করতে চায় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র। এরকম আরও কর্মসূচি আছে তাদের। কিন্তু জান্তার প্রতি তাদের সমর্থনে বামার তরুণ-তরুণীরা ক্ষিপ্ত। গেরিলাদের অগ্রগতিতে দেশটিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং বাড়তি সহিংসতার বিপদ দেখছে চীন। বিভিন্ন 'মুক্তাঞ্চলে' বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে পারস্পরিক ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন যে নেই তা নয়। এর একটা বড় কারণ, প্রতিরোধ সংগ্রামের সামনের সারিতে কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নেই।

সরকারবিরোধী এনইউজি বা 'জাতীয় ঐক্যের সরকার' সম্প্রতি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে চীনের বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেবে। বোঝা যাচ্ছে, চীনের আস্থায় আসতে চায় তারা। তবে গেরিলাযুদ্ধ বিজয়ী হলে শান ও কাচিন নিজ প্রভাবাধীন রাখতে চীন সব উপায়ে যে চেষ্টা করবে সেটা অনুমান করা শক্ত নয়। চীন লাগোয়া এই দুই এলাকা মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় দুই প্রদেশ। চীনের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এখানে বিপুল। তারা এখানে সামরিক প্রভাবও বজায় রাখতে চাইবে কোনো না কোনো উপায়ে।

ভারতের পক্ষে অবশ্য তার নিকটতম অঞ্চল চিন ও সাগাইংয়ে সেরকম প্রভাববলয় গড়ে তোলা কঠিন। তারাও সীমান্ত সুরক্ষার কথা ভাবছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীরা জান্তার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক নিয়েও অসুখী। অতীতে অং সান সুচির দলের সঙ্গে নয়াদিল্লির সুসম্পর্ক ছিল। তার দল এনএলডি ক্ষমতা হারানোর পর ভারত তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই জান্তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখছে। মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আসিয়ানমুখী যোগাযোগ এবং রাখাইন প্রদেশে বিপুল বিনিয়োগ রক্ষা করতে ভারত সামরিক সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতি নেয়। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় গেরিলাদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতেও এই কৌশল নিতে হয় তাকে। কিন্তু এখন তার সীমানার উল্টো দিকে গেরিলাদের অগ্রগতি ভারতের মিয়ানমার-নীতিকে বিপদে ফেলেছে। চিন প্রদেশের সঙ্গে তার যেসব 'ট্রেড রুট' ছিল সেগুলো ব্যবহার করতে এখন স্থানীয় চিন ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে নয়াদিল্লিকে।

লাওস, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ কী করবে?

আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড ও লাওসেও মিয়ানমারকে নিয়ে উদ্বেগ আছে। নেপিদো এখনো সুরক্ষিত হলেও অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। যুদ্ধে গ্রামগুলোতে চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটছে। পশ্চিমা অবরোধে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ঝামেলা চলছে। সামরিক ব্যয় বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। ফলে জান্তাকে উন্নয়ন প্রকল্প কমিয়ে আনতে হচ্ছে মোটাদাগে। এ অবস্থার একটা খারাপ ছাপ থাই ও লাওস সীমানায় পড়তে বাধ্য।
 
প্রতিবেশী হলেও ছোট দেশ লাওসকে কম পাত্তা দেয় মিয়ানমার। তবে লাওস এ বছর আসিয়ানের সভাপতি হয়েছে। মিয়ানমারের জন্য রাজনৈতিক সমস্যা খুঁজে বের করা তার নিজের স্বার্থেও জরুরি। তাদের বোকিও অঞ্চলের সঙ্গে মিয়ানমারের শান এলাকার যেখানে সীমানা সেটা সাইবার অপরাধীদের অভয়ারণ্য। আবার মিয়ানমারের এই অঞ্চল দিয়ে সুনামির মতো মাদক ঢুকছে লাওসে। এখানকার অপরাধীদের উৎখাত করতে চীনের মতো লাওসও বর্তমান সুযোগে গণতন্ত্রপন্থী গেরিলাদের কাজে লাগাবে কি না, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে সবাই। এ সপ্তাহে লাওস নেপিদোতে একজন আলোচকও পাঠিয়েছে।

এসব দেশের মতো মিয়ানমারে পরিবর্তন দেখতে চাওয়া বাংলাদেশের জন্যও অস্বাভাবিক নয়। কেবল শরণার্থীদের বোঝা বইতে বইতে দেশটি ক্লান্তই নয়, উদ্বিগ্নও বটে। গত ৯-১০ মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রায় আশি জন রোহিঙ্গা পারস্পরিক চোরাগোপ্তা হামলায় খুন হয়েছেন। শিবিরগুলো ধীরে ধীরে এত বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে যে, সেই বিপদ শিবিরের বাইরেও ভীতি ছড়াচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ছয় বছর শেষে এখন যেকোনো উপায়ে আশ্রিতদের ফেরত পাঠাতে চায়। এরমধ্যে আরেক দুশ্চিন্তা আরাকানে রাখাইন গেরিলাদের নতুন শক্তি হয়ে ওঠা। 'নতুন মিয়ানমারে'র মান্দালা মডেল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে কী চেহারা নেয় সেটিও বাংলাদেশকে ভাবাচ্ছে। যে ভাবনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেরও। কারণ তাতে 'জাতিরাষ্ট্রে'র ধারণায় আঁচড় পড়বে।  

এসব কি 'ঠান্ডাযুদ্ধে'র ফল?

মিয়ানমারে গেরিলা শক্তিগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কেবল এটুকুই যে, দেশটির কেন্দ্রীভূত শাসন পাল্টে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো হবে। নাগরিকত্ব আইন উদার হবে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতরা প্রদেশ ও কেন্দ্রে দেশ চালাবেন। এসব সাধারণ প্রত্যাশার বাইরের আরও অনেক বিষয়ে যে তুমুল বিতর্ক ও মতভেদ হবে সে-ও প্রায় সব গেরিলা দল মনে করে। এমনও উদ্বেগ আছে যে, এরকম বিতর্কে পড়ে প্রদেশগুলোর দূরত্ব বেড়ে যেতে পারে। সেরকম হলে বাংলাদেশকে যেমন রাখাইন প্রদেশ নিয়ে বিশেষ করে ভাবতে হবে, ভারতকে তেমনি চিন প্রদেশ ও সাগাইং বিভাগ নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়তে হবে। গণচীন চাইবে শান ও কাচিন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে। থাইল্যান্ডকে ভাবনায় ফেলবে কায়া, কায়িন ও তানিনথরি এলাকা। 

এখন মিয়ানমারের সীমানার ভেতর থাকলেও অতীতে এরকম অনেক অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত ছিল, কোনো কোনো অঞ্চল স্বাধীনও ছিল। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এসব এলাকার মানুষ অনেকে যেমন ফেডারেশন আকারে মিয়ানমারের ভেতর থাকার কথা বলছে, অনেকে আবার আলাদা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও ভাবে। আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য এসব একইসঙ্গে শঙ্কা ও সম্ভাবনার মুহূর্ত।
 
ঠান্ডাযুদ্ধ বরাবরই নতুন নতুন দেশের জন্ম দিয়েছে গত শতাব্দীতে। এ শতাব্দীতে মিয়ানমারে হয়তো তারই আলামত দেখা যাচ্ছে। যদিও গেরিলা-মিয়ানমারের চারপাশ এখনো কেন্দ্রীভূত 'স্থিতিশীলতা'র আমেজে অতিরিক্ত জমে আছে, কিন্তু এশিয়ায় বহুত্ববাদের এক চমক আসন্ন। বাংলাদেশের চার গুণেরও বড় আয়তনের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের দেশটি নিশ্চিতভাবে কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে এগুচ্ছে। 'মান্দালা মডেল' দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চিন্তার জগতকে আমূল নাড়া দিতে পারে। 

আলতাফ পারভেজ: 'বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক' (ঐতিহ্য, ২০১৯) বইয়ের লেখক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

8h ago