জাতীয় নির্বাচন: নিরপেক্ষতা বলে কিছু আছে কি

জাতীয় নির্বাচন এক ধরনের সর্বজনীন উৎসব। আমাদের দীনহীন বিবর্ণ জীবনে উৎসবের খুবই অভাব; সর্বজনীন উৎসব হিসেবে আছে, কাজে নেই। পাঁচ বছর পর পর সর্বজনীন নির্বাচনী উৎসব আসবার কথা, সময়টা বেশ বড়, চার বছর হলে ভালো ছিল; কিন্তু পাঁচ বছর পরেও তো সব সময়ে এই উৎসব আসে না।

নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয়। তবে ভোটারদের মধ্যে নয়, প্রার্থীদের মধ্যেই। প্রার্থী হতে অস্থির ব্যক্তিরা টাকা ঢালো, তাদের সমর্থকরা উন্মাদনা প্রকাশ করে। এ উন্মাদনা ভোট পর্যন্ত ও ভোটের দিনেও থাকবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত এই নির্বাচনে মানুষ চাইবে নিরাপদে ভোট দিতে। পছন্দ মতো ভোট দিতে পারলে তারা সুখী হবে।

কিন্তু নির্বাচন নিয়ে প্রহসনের যে পরম্পরা চলছে তাতে ভোটারবিহীন নির্বাচন হলে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের কোনো অবকাশই থাকবে না। বিগত নির্বাচনগুলো তারই প্রমাণ দিয়েছে। তবে যথার্থ সুখের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো তাদের ভাগ্য-পরিবর্তন। সব সময়েই তারা আশা করে আগের সরকারের চেয়ে পরের সরকার ভালো হবে, ফলে তাদের ভাগ্যে কিছুটা পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু তা ঘটে কি? ইতিহাস কী বলে? এবার তো সুযোগ নেই, একদলীয় নির্বাচনে।

ভাগ্য-পরিবর্তনের আশা দেখা দিয়েছিল দু'টি ঐতিহাসিক নির্বাচনে; একটি ১৯৪৬-এর, অপরটি ১৯৭০-এর। রীতিমত গণরায় বের হয়ে এসেছিল; কেবল যে সরকারের বিরুদ্ধে তা নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই। তাতে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক আয়তনে বদল ঘটেছে, কিন্তু পুরাতন রাষ্ট্রের কলকব্জা, ধরন-ধারণ, আইন-কানুন, নাগরিক নিপীড়ন, মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, সবকিছু সেই আগের মতোই রয়ে গেল। দুই দুইবার স্বাধীন হবার পরেও হতভাগ্য এই দেশে আমলাতন্ত্রের দুঃশাসন কমবে কী, উল্টো বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বেড়েছে ধনবৈষম্য। এত বৈষম্য এদেশে আগে কেউ কখনো দেখেনি।

সত্তরের নির্বাচনের পর একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে যে চেতনাটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল সেটি ওই ভাগ্য-পরিবর্তনেরই। নির্দিষ্ট অর্থে সেটা মুক্তির। মুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা তো অবশ্যই দরকার ছিল; কিন্তু কেবল ওই প্রাপ্তিতেই যে কাজ হবে সে বিশ্বাস মানুষের ছিল না। সাতচল্লিশের ব্যর্থ স্বাধীনতা একেবারে ঘাড়ে ধরে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে মুক্তির জন্য সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয়। কয়েকজন রাজা হয়ে থাকবে বাদবাকিরা গোলামি করবে, এ ব্যবস্থা মানুষের মুক্তি আনবে না। প্রত্যাশাটা ছিল সবার জন্যই থাকবে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ। তেমনটা ঘটেনি। মুক্তি আসেনি।

স্বাধীন বাংলাদেশের গত বায়ান্ন বছরের ইতিহাস মূলত বৈষম্য বৃদ্ধিরই ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে ছিল একটি সমাজবিপ্লবের চেতনা। কিন্তু হায়, সে-বিপ্লব ঘটলো না। উন্নতি হয়েছে, রীতিমত হুলুস্থূল করে; কিন্তু সে-উন্নতি পুঁজিবাদী, যার চালিকা শক্তি মুনাফালিপ্সা, এবং যার অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে নানা রকমের বৃদ্ধি; যেমন লুণ্ঠনের, ভোগবাদিতার, বিচ্ছিন্নতার, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের, প্রকৃতির ওপর নির্দয় আচরণের। মনুষ্যত্ববিনাশী এসব তৎপরতা আমরা দেখছি, এবং বাধ্য হচ্ছি মেনে নিতে।

এই সার্বিক দুর্দশার ভেতরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কয়েকটি সত্য আরও পরিষ্কার হচ্ছে। একটি হলো টাকার ভূমিকা। টাকা মনে হয় উড়ছে; কিন্তু এই উড়ন্ত পাখিরা মনিবের পোষ-মানা, তারা অন্য পাখিদের ভাগিয়ে নিয়ে আসবে। যারা টাকা খাটিয়েছে নির্বাচিত হলে সে-টাকা তারা বহু গুণে তুলে নেবে। ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদ বৃদ্ধির পুরো ছবিটা কখনোই পাওয়া যায় না, কিন্তু যা পাওয়া গেল তাতেই লোকের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। বোঝা গেছে ক্ষমতার কী শক্তি!

আরও বড় ঘটনা হলো বুর্জোয়া রাজনীতির মতাদর্শিক দীনতার উন্মোচন। বুর্জোয়াদের দু'টি জোট আগেও ছিল। ছোট ছোট দলগুলো বড় দুই জোটে শামিল হবে; তাতে ছোটদের লাভ, বড়দের লাভটাও কম নয়। কিন্তু মতাদর্শিক বিবেচনায় দুই জোটের ভেতর পার্থক্যটা কোথায়? কতটুকু? বস্তুগত একটা পার্থক্য অবশ্যই আছে। সেটি হলো পনেরো বছর ধরে একটি জোট ক্ষমতায় আছে, ফলে তাদের সুযোগ সুবিধা ও যোগাযোগ অনেক বেশি, আর অন্য জোটটি রয়েছে ক্ষমতার বাইরে, তাই তাদের অসুবিধা অধিক। কিন্তু এর বাইরে? মতাদর্শের ব্যাপারে? যেমন ধরা যাক জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটা। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল; কিন্তু তাদের জোটে তো হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের পার্টিকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। ওই পার্টি কেবল যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তাই নয়, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মেরও সংস্থাপক। সংবিধান রচনাতে কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আদি সংবিধানে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই বোঝানো হয়েছে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আগমন বিএনপি'র হাত ধরে; অথচ তাঁর অবস্থান এখন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গেই।

কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর বাইরে কাউকে নেতা মানেন না, কিন্তু তিনি এখন আর নৌকাতে নেই, গামছায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের কথা তুলেও আর লাভ নেই; মুক্তিযোদ্ধারা দুই জোটেই আছেন। আর এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে সরাসরি লড়াই করেছেন বলে অভিহিত একজন তো আওয়ামী জোটের মনোনয়নই পেয়ে বসেছিলেন। তাহলে? বলা হয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এমন নিরেট ও নিষ্ঠুর কথা তারাই বলতে পারে যাদের কাছে মতলব হাসিলটাই মুখ্য, মতাদর্শ তুচ্ছ।

আর ইসলামপন্থি দল? তারা তো উভয় জোটেই দৃশ্যমান। ওদিকে আদি সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি উল্লেখ ছিল, তাদের কথা তো এখন তেমন আর শোনাই যায় না। সংশোধিত হতে হতে মূলনীতি চারটির দশা শুকনো গাছের মতো, পাতা যা ছিল ইতিমধ্যে ঝরে গেছে, গাছটিও ক্রমাগত শুকাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রত্যয় প্রগতিশীলরাও এখন আর ব্যক্ত করেন না, মৃদু কণ্ঠে বলেন অসাম্প্রদায়িকতা চাই।

বাংলা বর্ণমালার 'ব' এবং 'র'-এর ব্যবধান সামান্য একটি বিন্দুর, কিন্তু তবু তারা একেবারেই আলাদা, যেন দুই স্বতন্ত্র জগতে তাদের বসবাস; মতাদর্শের ক্ষেত্রে আমাদের দুই রাজনৈতিক জোটের দৃশ্যমান ব্যবধান ওই বিন্দুর মতোই ছোট, কিন্তু তাই বলে তাদের ভেতরকার দূরত্ব যে বর্ণমালার দু'টি অক্ষরের মতো দুই ভিন্ন জগতের তা কিন্তু মোটেই নয়। মতাদর্শের ক্ষেত্রে তারা ঘনিষ্ঠজন, ভাই-ভাই বলা যায়; লড়াইটা চলছে অনার্জিত সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে।

আমেরিকাতে যেমন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা আছে, নির্বাচনে লড়াই চলে হাতি ও গাধাতে, কিন্তু উভয় দলই অবিচল থাকে পুঁজিবাদী অবস্থানে, আগামীতে আমরা হয়তো দুই জোটকে ওই রকমের বড় দুই দল হিসেবেই পাবো, লড়াই চলবে নৌকাতে আর ধানের শীষে। কেননা এবার ধানের শীষ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে মনে হচ্ছে না। একদলীয় একতরফা নির্বাচনই হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে স্পষ্ট হবে এই সত্যও যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল যতই থাকুক না কেন, রাজনীতির ধারা কিন্তু দুটোই—একটি দক্ষিণপন্থি অপরটি বামপন্থি।

বুর্জোয়ারা যেখানেই এবং যে পোশাকেই থাকুক, তারা সবাই পুঁজিবাদে ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় বিশ্বাসী। সে-কারণে সবাই তারা নির্ভুলরূপে দক্ষিণপন্থি। দক্ষিণপন্থার সীমাটা খুবই বড়, সেটা পরিষ্কার উদারপন্থা থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মৌলবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত।

দক্ষিণপন্থি এই ধারার ঠিক বিপরীতে অবস্থান বামপন্থিদের, যারা পুঁজিবাদবিরোধী এবং ব্যক্তি মালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ। নির্বাচনকে সামনে রেখে বামপন্থিরাও একটা জোটে মিলিত হবেন নিশ্চয়। কিন্তু তাঁরা মূলধারার কাছে তো নয়ই, অত্যন্ত দুর্বল অবস্থাতেই রয়ে যাবেন। বামপন্থিরা মেহনতিদের পক্ষের দল; পুঁজিবাদী উন্নতির নিষ্পেষণে পড়ে ওই মেহনতিরা হয় নিঃস্ব হয়ে গেছে, নয়তো নিঃস্ব হওয়ার পথে আছে। সমাজে মেহনতিরা আজ যতটা অসহায়, তাদের পক্ষের জোটও ততটাই দুর্বল। অথচ মেহনতিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যায় তারা বিপুল, এবং তাদের মেহনতের ওপর ভর করেই উন্নতির সৌধটা লকলক করে ওপরে বাড়ছে। অর্থনীতিতে বুর্জোয়াদের যে আধিপত্য তাদের ক্ষতিকর রাজনীতিও আজ ততটাই প্রধান ও প্রবল হয়ে উঠেছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় মানুষের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও বেকারত্ব বাড়ছে, মাদকাসক্তি মানুষকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, ধর্ষণ ও নারী-নির্যাতন ঘটছে যত্রতত্র, সড়কে রীতিমত নরহত্যা চলছে, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, জবাবদিহিতা এখন লজ্জায় মুখ দেখায় না, বিপর্যস্ত প্রকৃতি ও পরিবেশের নীরব ক্রন্দন কেউ শুনছে না। সর্বোপরি, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থা উৎপাদনের শক্তিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে, যে জন্য দারিদ্র্য দূর হবার পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বুর্জোয়ারাই তো ক্ষমতায় আসবে, কিন্তু তারা এই অবস্থার সামাল দিতে পারবে এমন ভরসা অন্যদের তো নেই-ই, তাদের নিজেদেরও নেই। ভরসা আসলে সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতিই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বামপন্থিরা যদি বুর্জোয়াদের রাজনীতির চেহারার উন্মোচন এবং নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারেন তবে সেটা হবে একটা জরুরি অর্জন। তাঁদের নিজেদের জন্য তো অবশ্যই, দেশের মানুষের জন্যও বটে।

আমেরিকার নির্বাচনে হাতি ও গাধার লড়াইতে সে-দেশের মানুষের মুক্তি যে আসবে না সেটা যেমন স্পষ্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই যে মানুষকে মুক্তি দেয়নি, দিতে পারবে না তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। বার্নি স্যান্ডার্স নামে একজন সাহসী ও ঘোষিতরূপেই সমাজতন্ত্রী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের দলের অর্থাৎ ডেমোক্রেটদের সমর্থনও শেষ পর্যন্ত পাননি। বোঝা গেছে সমাজতন্ত্রীদের স্বতন্ত্র দল চাই। এই বোধটা এখন সবদেশেই শক্তিশালী হচ্ছে। বাস্তবতাই বুদ্ধি যোগাচ্ছে।

তা আমাদের এই সর্বজনীন উৎসব তো আসবে, যাবে; কিন্তু বাস্তবতাটা রয়েই যাবে। তার উন্মোচনও নতুন নতুন ভাবে ঘটবে, ঘটতেই থাকবে। তবে আমাদেরকে প্রত্যেককেই ঠিক করতে হবে, দক্ষিণ ও বামের চরম যুদ্ধে আমরা কে কোন পক্ষে। নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কোনো কালেই ছিল না, এখন যখন মেরুকরণ ব্যাপক ও গভীর হয়েছে তখন তো নিরপেক্ষতার কোনো সুযোগই নেই; নিরপেক্ষতা অর্থ হচ্ছে পক্ষপাতিত্বকে লুকিয়ে রাখা। নিজের সঙ্গে প্রতারণা করাটা কি বাঞ্ছনীয়?

Comments

The Daily Star  | English

Need to mobilise youth power for new civilisation: Yunus at COP29

The chief adviser highlighted the fact that the climate crisis is intensifying

43m ago