সব সুবিধা আমলাদের জন্য?
'জীবনের সোনালি সময় পার করে দিলাম পদোন্নতির অপেক্ষায় থেকে থেকে। পদোন্নতি আর হলো না। উনিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি, এখনও সহকারী অধ্যাপক। অথচ প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হলে এত বছরে যুগ্ম সচিব হয়ে যেতাম।'
ময়মনসিংহের একটি সরকারি কলেজের একজন শিক্ষকের এই আক্ষেপ বাংলাদেশের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থা তথা সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের একটি স্থিরচিত্র। এবার সাম্প্রতিক তিনটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক।
১. আরেক দফা পদোন্নতি ভোটের আগেই: আজকের পত্রিকা, ০৯ অক্টোবর ২০২৩।
২. ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১ গাড়ি, প্রতিটির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা: দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন, ১২ অক্টোবর ২০২৩।
৩. দাবি আদায়ে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা: প্রথম আলো, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রশাসনে আরেক দফা পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এবার সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে প্রায় ২৫০ জনকে। এর আগে গত মাসেই ২২১ জনকে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তাতে প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়ায় পদের চেয়ে প্রায় তিন গুণ। মে মাসে ১১৬ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। ওই পদোন্নতির ফলে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৬। অথচ অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৪০।
তার মানে পদ না থাকলেও পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনের মাথা ভারী করা হচ্ছে। অথচ সরকারি কলেজগুলোয় অসংখ্য পদ ফাঁকা। বছরের পর বছর ধরে তাদের পদোন্নতি নেই। প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার ২০ বছরে মাত্র একটি পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন—এই সংখ্যাটা অগণিত।
অনেকটা একই অবস্থা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদেরও। তাদেরও পদোন্নতি হয় না। হলেও সামান্য এবং অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়। যে কারণে দেখা যায় মেডিকেল থেকে পাস করার পরেও বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার বা পুলিশে যোগ দিচ্ছেন অনেক মেধাবী তরুণ। অথচ তাদেরকে মেডিকেলে পড়াতে গিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
কেন মেডিকেলে পড়েও তারা প্রশাসন ক্যাডার বা পুলিশে যোগ দিচ্ছেন? কারণ, সম্মান ও অর্থ। শিক্ষকদের অর্থ নেই, এমনকি পদোন্নতি দিয়ে যে সম্মানটুকু নিশ্চিত করা হবে, তারও উদ্যোগ নেই। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে শিক্ষকদেরকে সরকারের কোনো কাজে লাগে না কিংবা রাষ্ট্রে তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। সব কাজ প্রশাসন ক্যাডার এবং পুলিশ করবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিশেষ বিশেষ সার্ভিসের লোকদেরকে খোদ সরকারও ভয় পায়। যেখানে শিক্ষকরা বঞ্চিত। চিকিৎসক এবং আরও অনেক সার্ভিসের লোক বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। অথচ যিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, প্রত্যেকেই একসময় ছাত্র ছিলেন। সেই হিসেবে শিক্ষকের বেতন, আর্থিক সুবিধা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হওয়ার কথা ছিল সবার চেয়ে বেশি। কিন্তু সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে এখন সরকারি কলেজের শিক্ষকরাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত, হতাশ।
যাদেরকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর; যারা জাতিকে আলোকিত করেন—তাদের পদোন্নতি নিয়ে ভাবনা নেই। অথচ বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে যেসব খাতের লোকজন কোটি কোটি টাকা কামাই করেন, তাদের গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণসহ আরও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যতিব্যস্ত।
কারণ, প্রশাসনের লোক এবং পুলিশকে দিয়ে জনগণকে 'শাসন' করা সহজ। শিক্ষকদের দিয়ে যে কাজটি করা সম্ভব নয়। ভোটের রাজনীতিতে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশকে যতটা কাজে লাগে, সরকারি কলেজের ততটা কাজে লাগে না। অতএব কেউ যদি ২০ বছর শিক্ষকতা করার পরেও সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হতে না পারেন, বুঝতে হবে রাষ্ট্র তাকে গোনে না। রাষ্ট্র গোনে আমলাদের।
অতএব রিজার্ভে যতই টান থাকুক; দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যতই খারাপ হোক; বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস যতই উঠুক—ভোটের আগে তাদেরকে খুশি রাখতে রাষ্ট্রের প্রচেষ্টার অন্ত নেই।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সরকার যখন ব্যয় কমাতে কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করছে, তখনই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২৬১টি স্পোর্টস ইউটিলিটি গাড়ি (এসইউভি) কিনতে যাচ্ছে। মিৎসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স মডেলের প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে এক কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা।
প্রশ্ন হলো, সরকার নিজেই যখন রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানোর কথা বলছে এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরও নিরুৎসাহিত করছে, সেই সময়ে কেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য আড়াইশোর বেশি গাড়ি কিনতে হবে? এর মধ্য দিয়ে সরকার কি নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত অমান্য করছে না?
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য এই সংকটের ভেতরেও কেন ডিসি ও ইউএনওদের জন্য কোটি টাকা দামের গাড়ি কেনা হচ্ছে তার একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, 'যাদের জন্য গাড়ি কেনা হচ্ছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য।' মন্ত্রী বলেন, সরকার একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল গাড়ি কেনা বন্ধ রাখার জন্য। সেই নিষেধাজ্ঞা এই নির্বাচনের প্রয়োজনে শিথিল করা হয়েছে বলেই ২৬১টি গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। (প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর ২০২৩)
প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচনের সময় সাধারণত ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখন ডিসি এবং ইউএনওরা যে গাড়িতে চড়ছেন বা ব্যবহার করছেন, সেই গাড়ি কি আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে অকেজো কিংবা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যাবে? এই গাড়িগুলো দিয়ে কি নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করা যাবে না?
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, ভোটের সময় রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা কি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দৌড়ঝাপ করেন এবং সেই ছোটাছুটির জন্য তাদের জন্য নতুন গাড়ির প্রয়োজন হয়? প্রতিবেশী ভারত কিংবা অন্যান্য দেশেও কি ভোটের আগে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জন্য নতুন গাড়ি কিনতে হয়? অর্থাৎ ভোটের সময় দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বলে তাদেরকে নতুন গাড়ি দিতে হবে এবং তাও দেশ যখন একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; যখন নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষ হাঁসফাঁস করছে; যখন মাছ-মাংস-ডিম এমনকি সবজির দাম নিয়েও মানুষ ক্ষুব্ধ—সেই সময়ে আমলাদের জন্য এই 'গাড়ি বিলাস' কি তাদেরকে তুষ্ট করা ছাড়া আর অন্য কিছু?
যদিও আমলাদের তুষ্ট করা বা খুশি রাখার এই প্রবণতা নতুন নয়। পদ না থাকার পরে অপ্রয়োজনে গণহারে পদোন্নতিও প্রশাসনে নিয়মিত। অথচ অন্য আরও অনেক সরকারি চাকরিজীবী বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতির আশায় বসে থাকেন। এমনকি চিকিৎসকদের বিরাট অংশ ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলোয় থাকতে চান না ডিসি এবং ইউএনওদের খবরদারির কারণে—এই অভিযোগও বেশ পুরোনো।
সরকারি কলেজদের শিক্ষকদের কথা না হয় বাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ফলাফল এমনকি মেধা ও যোগ্যতায় অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিসিএস পরীক্ষায় ফলাফলের ভিত্তিতে একজন লোক চাকরিতে যোগদানের পর থেকেই নিয়মিত বিরতিতে পদোন্নতি পাচ্ছেন; দামি গাড়ি-বাড়ি পাচ্ছেন; নিয়মিত বিদেশ সফর; বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে মোটা অংকের টাকা কামানোর সুযোগ এমনকি চাকরির বয়স ২০ বছর হওয়ার আগেই অনেকে কানাডা-আমেরিকায় বাড়ি কিনে ফেলেছেন; সন্তানরা বিদেশে পড়ছেন—এরকম কথাও আকসার শোনা যায়।
অথচ একই যোগ্যতার এবং মেধার আরেকজন চাকরিতে যোগদানের পরে ১৯ বছর ধরে অপেক্ষা করছেন একটা পদোন্নতির জন্য। চাকরি শেষ হয়ে যাবে অথচ জীবনে হয়তো নামের সঙ্গে অধ্যাপক শব্দটিও লিখতে পারবেন না। আবার সরকারি কলেজের অধ্যাপক হলেও তার মর্যাদা একজন সচিবের সমানও হবে না। ফলে মেধাবীর এবং প্রকৃতই যারা ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন বা আসতে চান, তারা দেখছেন তাদের জন্য চারিদিকে হতাশার জাল বিছানো। অনেকেই পালাবার পথ খোঁজেন।
কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো কাজ করার চিন্তা করেন। কিন্তু ব্যবসা করার মতো পুঁজি ও পরিবেশ আছে কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন। অথচ প্রশাসনে এবং অন্য আরও কিছু পেশার লোকজন সর্বোচ্চ পদে গিয়ে অবসরে যাওয়ার পরে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কমিশনের শীর্ষ পদে বসছেন। বিভিন্ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে অবসরের পরেও বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন।
এরকম একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্পিরিট যে 'সাম্য ও সামাজিক সুবিচার' সেটিই বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রাষ্ট্রের সব সুবিধা যখন একটি গোষ্ঠীর পকেটে চলে যাবে, তখন অন্য সব গোষ্ঠীর ভেতরে যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে, সেটি কোনো না কোনো সময়ে গিয়ে বিস্ফোরিত হলে তার মূল্য দিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments