টিকটক-লাইকি যেমন জনপ্রিয়, সচেতন না হলে তেমনই বিপজ্জনক

টিকটক ও লাইকির মতো অ্যাপ বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম। লক্ষ্য করেছি, পরিচিত অনেকেই নানাভাবে টিকটক ব্যবহার করছেন। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে এই অ্যাপ সবচেয়ে জনপ্রিয়।

তবে, বিপদের কথা হচ্ছে, এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারী নারী ও মেয়েরা নানা ধরণের হয়রানিতে পড়ছে।

টিকটক বা লাইকি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই তেমন কোনো ধারণা নেই বা ছিল না। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আছেন, তারা দেখেছেন, দুনিয়া জুড়ে ফেসবুকে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা টিকটকে বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার করছেন। সেখানে কখনো নিজের, কখনো বন্ধু-বান্ধবের, আবার কখনো পরিবার কিংবা পশুপাখির ভিডিও থাকছে।

ভাইরাল হওয়া নাচ ও গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ভিডিও তৈরি এবং শেয়ার করতেও দেখেছি এই টিকটক অ্যাপে। কিন্তু বাংলাদেশে এই অ্যাপটি বিনোদনের পাশাপাশি আর কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা জানতাম না।

প্রায় ৩ বছর আগে যখন ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও দেখা গেল ফেসবুকে, তখন সাধারণ মানুষ টিকটকের অপব্যবহার সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারলেন। এই ঘটনা ২ দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে রীতিমত ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।

এরপর টিকটকের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ভারতে পাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসতে থাকে। অভিভাবক, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিক বা অন্যান্য পেশাজীবীরা কেউই জানতে পারেননি যে টিকটক ও লাইকির মতো অ্যাপস ব্যবহার করে নারী পাচারকারীদের এত বড় একটা চক্র বছরের পর বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে।

টিকটক ও লাইকির জনপ্রিয়তার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কমবয়সী মেয়েদের বলা হয়, তাদেরকে টিকটক 'স্টার' বানিয়ে দেওয়া হবে। পরে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো, পাচার, ধর্ষণ, আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কিছু করাতে বাধ্য করা, এমনকি হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। অথচ অনেকগুলো বছর ধরে কেউ জানতেই পারেনি, কীভাবে মেয়েরা প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন।

'A New Avenue of Crime in Bangladesh: TikTok as a Weapon of Violence Against Women & A New Challenge to Gender Equality in Bangladesh: TikTok facilitating Trafficking and Sexual and other types of Exploitation' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যম আমরা জানতে পেরেছি, কীভাবে টিকটক, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম ও ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।

প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর আধেয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭০টি খবরের মধ্যে ৩০টিতে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উপস্থাপন করছে। এর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে টিকটক। গবেষণা প্রতিবেদনে বেশ কিছু কেস স্টাডিও তুলে ধরা হয়েছে।

টিকটকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০১৮ সালের প্রথম ৩ মাসে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা হয় এই অ্যাপ। টিকটক ভিডিও প্রায় ৪০টি ভাষায় প্রচলিত। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিগো টেকনোলজি ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৈরি করে লাইকি। বিশ্বের নানা দেশে প্রায় ৩৭টি ভাষায় তৈরি করা যায় লাইকি ভিডিও।

এসব অ্যাপে ভিডিও নির্মাতাদের বয়স ২০-২৫ বছর হওয়ার কথা থাকলেও, কম বয়সী ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন। সহজে ভিডিও তৈরি করা, নতুন কোনো বাস্তবতা যুক্ত করা, জুম, স্ক্রিন ছোট-বড়, ঝাপসা করা ইত্যাদি খুব সহজেই কম বয়সীদের আকৃষ্ট করছে। এতে সহজেই অপব্যবহারকারী বা অপরাধীরা এই সুযোগ লুফে নিয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে।

পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যে এভাবে নারীপাচার কার্যক্রম চলছে, তা বুঝতে দেরি হয়ে গেছে। তাদেরও ধারণা ছিল যে এসব অ্যাপস বাকি দুনিয়ার মতো এখানেও মজার জন্য সবাই ব্যবহার করছে। কিন্তু পরে দেখেছে, তরুণদের একটা গ্রুপ সংগঠিত হয়ে এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে অপরাধ করছে।

একজন টিকটক বা লাইকি ব্যবহারকারীর ১ হাজারের বেশি ফলোয়ার হলে তিনি তার ভক্তদের জন্য লাইভে আসতে পারেন। ২০১৯ সালের শুরু থেকেই ডাউনলোড চার্টের শীর্ষের কাছাকাছি অবস্থান করছে টিকটক। বাংলাদেশে লাইকির চেয়ে টিকটক এগিয়ে। বেশির ভাগ টিকটকার কম বয়সী। লাইকি ও টিকটকের জন্য খুব সামান্য সেটআপ ও দক্ষতা দরকার হয় বলে যে কেউই খুব সহজেই এই সাইবার-বিনোদন জগতে প্রবেশ করতে পারে। প্রয়োজন শুধু একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। অ্যাকাউন্ট খুলতেও খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। টিকটকের রিপোর্টিং সিস্টেমে অশ্লীল বিষয় বা আধেয়কে আলাদা করে দেখানো হয় না বলে, যার যা খুশি আপলোড করতে পারে।

শুধু টিকটক বা লাইকি নয়, দেশে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠছে, যারা ফাঁদে ফেলে শিশু ও নারীদের নিয়ে ব্যবসা করছে। সিআইডি সদস্যরা ২০২৩ সালের মে মাসে এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে 'পমপম' নামের একটি গ্রুপ খুলে সদস্যরা নানাভাবে কিশোরী ও তরুণীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। অনেক সময় এই সম্পর্ক প্রেমের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এরপর কিশোরী-তরুণীর ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। পরে এসব ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি করে।

টাকা দিতে না পারলে মেয়েদের ভিডিও কলে এনে তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করাতে বাধ্য করে। পরে সেসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করে। মাসে ১ থেকে ২ হাজার টাকা ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশে অবস্থানরত বহু ব্যক্তি গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদের আপত্তিকর ছবি-ভিডিও কিনে সংরক্ষণ করে।

বাসা, পাড়া-মহল্লা, দাওয়াত বাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বাস-ট্রেন-লঞ্চ, ডাক্তারের চেম্বার—যেখানেই যান, লক্ষ্য করবেন কোনো শিশুর হাত মোবাইলবিহীন নয়। বাবা-মা ও অভিভাবকদের অভিযোগ বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়ে ও ছোট বাচ্চারা মোবাইল থেকে চোখ সরাতে চাইছে না।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৬৪ লাখের বেশি। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮৬ লাখ। বাকিরা মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে।

এরমধ্যে ঠিক কতজন শিশু মোবাইল ফোনের মালিক এবং কতজন ইন্টারনেটের গ্রাহক তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও, এটা অনুমান করা যায় যে দেশের ৩ থেকে ৪ কোটি শিশু-কিশোরের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার আছে।

ইন্টারনেট ব্যবহারে সন্তানের চেয়ে দক্ষতায় পিছিয়ে আছেন অনেক অভিভাবক। সেই সুযোগে সন্তানরা মা-বাবাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ৩১ শতাংশ শিশু অনলাইনে যৌনতাবিষয়ক বার্তা, ছবি, ভিডিও পেয়েছে। অথচ মা-বাবারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এ দেশের একটা বড় সংখ্যক অভিভাবক জানেন না যে অনলাইনে ঠিক কী ধরনের বিষয়বস্তু রয়েছে, এই জগতে কী ধরণের বিপদ ওৎ পেতে বসে আছে। অভিভাবকদের মধ্যে যারা নিরক্ষর এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন অ্যাপস সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না, তাদের জন্য তো আরও কঠিন এসব তথ্য জানা। এমনকি অন্যান্য অভিভাবকদের পক্ষেও অনলাইনে ঢুকে প্রতিনিয়ত বাচ্চার গতিবিধিতে নজর রাখা প্রায় অসম্ভব।

বেঙ্গালুরুর ঘটনা সমানে আসার পর সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে এসবের নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে। শুধু ভ্যাট নিবন্ধন করে পুরো সমস্যার সমাধান কি করা যাবে? অনেকেই বলছেন, এইসব অ্যাপস বন্ধ করা হোক। টিকটক-লাইকি বন্ধ করলেই কি সমাধান হবে?

বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র একটি আলোচনা সভায় বলেছেন, 'এসব অ্যাপ বিটিআরসি চাইলেই বন্ধ করতে পারে না। যে কেউ এসব প্ল্যাটফর্মে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। তবে আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য ইন্টারনেট কানেকশন নেওয়ার সময় প্যারেন্টাল গাইডটি অভিভাবকদের পড়া উচিৎ।'

শুধু আইন বা পুলিশী তৎপরতা দিয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ ঠেকানো যাবে না। প্রযুক্তির ব্যবহারও বন্ধ করা অসম্ভব। তাই চেষ্টা করতে হবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানোর। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে সর্বাগ্রে। সেইসাথে সন্তানদের সচেতন করতে হবে।

আইন শৃঙ্খলাবাহিনী, গণমাধ্যম ও স্কুলকে বড় দায়িত্ব নিতে হবে। অভিভাবক এবং শিক্ষক সবাইকেই 'ওভার সেক্সুলাইজেশন' বিষয়টি বুঝতে হবে। অ্যাপস ব্যবহার করা কোনো অপরাধ নয় এবং অ্যাপস ছাড়া বর্তমানে চলা যাবে না। কিন্তু এর অপব্যবহার দুর্ভাগ্যজনক।

এই ব্যবসায় জড়িত হোতাদের চিহ্নিত করতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ইন্টার-অ্যাকশনস এর মনিটরিং বাড়াতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পুলিশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও বিশেষায়িত জ্ঞান বাড়াতে হবে। ৪ বছরের শিশু থেকে ২৫ বছরের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে প্রযুক্তিতে আসক্ত। এসব অ্যাপসের সুবিধা ও মজা যেমন আছে, সচেতন না হলে বিপদ আছে আরও বেশি।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, যোগাযোগ কর্মী

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago